২০১৯ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে আমি লন্ডন শহরে এসেছিলাম আমার স্নাতক স্তরের পড়াশোনা করার জন্য। প্রথমবার ফেব্রুয়ারি মাসে শুনলাম করোনাভাইরাসের বিষয়ে। তখন লন্ডন শহরে সব কিছু একদম স্বাভাবিক ভাবে চলছে। মার্চের শুরুর দিকে প্রথম কলেজ থেকে নোটিস পাই যে, ভাইরাসটা ব্রিটেনেও সক্রিয় হচ্ছে। তাই আমাদের সবাইকে গাইডলাইন মেনে সচেতন হতে হবে ব্যক্তিগত, এমনকি সামাজিক স্তরেও। তবু ক্লাস একইরকম চলছিল। জীবনযাপনে খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি তখনও।
১৯ মার্চ সকালবেলা যখন কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম, আরেকটা নোটিস পেলাম যে, আমাদের ক্লাস বাতিল হয়ে গিয়েছে এবং তারপরেই ২০ মার্চ থেকে সরাসরি সাক্ষাৎ বন্ধ। আমার সব ইউরোপীয় বন্ধুরা তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি চলে গেল। ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাঁরা আমার হস্টেলে থাকত, তারাও চলে গেল। শুধুমাত্র পড়ে রইলাম আমি আর আমার মতো বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিদেশি পড়ুয়ারা। তখন সময়টা একটা সেমিস্টারের মাঝখানে। প্রায় দেড় মাস তখনও বাকি আছে ফাইনাল পরীক্ষার। প্রচুর লেকচার এবং প্রাকটিক্যাল ক্লাস বাকি। এর সাথে সাথে আমি আবার বিভিন্ন ল্যাবে পরীক্ষার পর ইন্টার্নশিপের জন্য অ্যাপ্লাইও করছিলাম।
২১ মার্চ আমার মা-বাবার ফোনে প্রথম জানতে পারলাম যে, ভারত তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। একটা দেশ নিজের নাগরিকদের আর তার দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তবু বাকি সব দেশের পড়ুয়াদের সঙ্গে আমি হস্টেলেই থেকে গেলাম। তার সাথে লন্ডনের বিভিন্ন বন্ধুবান্ধবদের সাথে লাইব্রেরি, কফি শপ, স্টাডি হল ইত্যাদি জায়গায় দেখা হতে লাগল মাঝে মাঝেই। জীবন তখনও বেশ স্বাভাবিক আছে।
তারপর ব্রিটেন জুড়ে লকডাউন জারি করে দিল। দৈনন্দিন জিনিসপত্র বা এক ঘণ্টা শারীরিক কসরতের জন্য ছাড়া আমাদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হল। আমাদের এ-ও বলা হল যে, খুব প্রয়োজন ছাড়া পাবলিক ট্রান্সপোর্ট যেন আমরা না ব্যবহার করি। কলেজও সব পরীক্ষা অনলাইন করে দিল এবং সব ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেল। সব লেকচার অনলাইনে আপলোড হতে লাগল। প্রাকটিক্যাল ক্লাসগুলো বাতিল হল। একইসঙ্গে লাইব্রেরিতেও লোক আসা বন্ধ হয়ে গেল। বাকি সব দেশ নিজেদের নাগরিকদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল একে একে। শুধু পড়ে রইলাম আমি এবং আরও কয়েকজন ভারতীয় পড়ুয়া। আমাদের ইউনিভার্সিটি আর রেসিডেন্স বারবার বলতে লাগল, যতদিন আমরা এখানে থাকব, আমাদেরকে সবরকম সাহায্য করবে। কিন্তু ক্লাস, প্রফেসর, পড়ুয়া, বন্ধু ছাড়া ইউনিভার্সিটির মজাটা কোথায়?
কিংস কলেজের বড় হস্টেলটা একটা ভুতুড়ে বাড়ির সমান হয়ে গেল। আমার গোটা উইং-এ আমি একা ছিলাম। প্রত্যেকদিন আমি পাগলের মতো খুঁজতাম, যদি ভারত নিজের সীমান্ত খুলে দেওয়ার কোনও ঘোষণা করে তাদের নাগরিকদের জন্য। কিন্তু কোনও খবর পেতাম না! আমাদের হোস্টেলে আমাদের নিজেদের থেকে বাজার করা, রান্না করা আর ঘরদোর পরিস্কার রাখার কথা। লকডাউনের প্রথম কয়েক দিন দোকানগুলোতে প্রায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাকে প্রায়ই না খেয়ে থাকতে হচ্ছিল। বিশেষ করে রাতগুলো খুব লম্বা লাগত। ঠিক করে ঘুমাতেও পারতাম না। এ ভাবেই দিন গুনছিলাম সীমান্তের ওপারে আমি আর এপারে আমার উদ্বিগ্ন মা- বাবা।
মার্চের শেষের দিকে আমার মা-বাবা আমাকে তাঁদের বন্ধুদের সাথে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলল। এখন আমি তাঁদের সাথেই আছি। এখন নিজের একটা ঘর আছে। ঠিকমতো খাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি আর ফাইনাল সেমিস্টার পরীক্ষার জন্য পড়াশোনাও করছি টুকটাক। নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে করি যে, এই রকম একটা ভাল পরিবার এই দুঃসময়ে আমার পাশে আছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বাড়ি থেকে অনেক দূরে আমার ১৮তম জন্মদিনটাও চুপচাপ ভাবে পার হয়ে গেল।
তবু আশা ছাড়িনি। রোজই খবর নিতে থাকি, যদি ভারত সীমান্ত খুলে দেয় নিজের নাগরিকদের জন্য। কিন্তু আজও কোনও খবর নেই।
আদ্রিজা মহাপাত্র
লন্ডন
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে)