লকডাউনে জনশূন্য ভিবর্গের রাস্তা।
প্রায় ছ’মাস ধরে ডেনমার্কের ভিবর্গ শহরে আছি কাজের সূত্রে। এখানে আসার পর প্রথম ৩-৪ মাস ভালই লাগছিল। নতুন জায়গা। ইস্টার হলিডে-তে কলকাতায় গিয়ে স্ত্রী আর এক বছরের মেয়েকে নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু বাদ সাধল এক অজানা অতিথি। শুধু আমার নয়, গোটা পৃথিবীকে এক ধাক্কায় স্তব্ধ করে দিয়েছে ভয়ঙ্কর সেই ভাইরাস ‘করোনা’।
মার্চের একটা সময় থেকে অফিস লাঞ্চে নিউজে সবাই দেখতাম চিনে ভাইরাসটা বেশ সক্রিয়। তারপর হঠাৎ যেন কীভাবে ভাইরাসটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল খুব কম সময়ে। ডেনমার্ক সরকার মার্চের মাঝামাঝি থেকে বেশ কড়া পদক্ষেপ করেছে এই ভাইরাস-সংক্রমণ ঠেকাতে। যেটা যথেষ্ট স্ট্র্যাটেজিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক। ডেনমার্কের প্রত্যেকে সেটা মেনে চলছে গত প্রায় এক মাস ধরে। শুধু যে এলাকা সংক্রমিত নয়, সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রতি সপ্তাহে বিলি করা হচ্ছে, যা সত্যি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে সাহায্য করছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আর মুদিখানার দোকানগুলোতে এক বারে কম সংখ্যক লোক ঢুকতে দেওয়া এবং সামাজিক দূরত্ব আগে থেকেই মেনে চলছে এখানকার লোকজন। স্থানীয় সংক্রমণ খুবই কম। লকডাউন চলছে গত ৩ সপ্তাহ ধরে। বেশিভাগ লোক বাড়ি থেকে সপ্তাহে ১-২ বার বেরোছে। অন্তত নিত্যপ্রয়োজনীয় ও খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহের জন্য। ভিবর্গ একটা ছোট শহর। জনসংখ্যা খুব কম, ৪০০০০ এর কাছাকাছি। যেটা নাকি ডেনমার্কের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ। আর এই জন্যই হয়তো এখনও এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ঘাটতি নেই। কিন্তু কিছু বড় শহর আরহুস, আলবর্গ বা কোপেনহেগেন— এই সব জায়গায় কিছুটা ঘাটতির খবর মিলছে।
রিপোর্ট অনুযায়ী ডেনমার্কে মোট করোনা আক্রান্ত ৬,১৭৪, যার মধ্যে ২৭৩ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই করোনা। কিন্তু আশার আলো এটাই যে, ২১২৩ জন ইতিমধ্যেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৩৫%।
সরকার ইস্টার হলিডের পর একটা সফ্ট ওপেনিং-এর কথা ভাবছে। কিন্ডারগার্টেন থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল চালুর কথা চলছে। যদিও বেশিরভাগ বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সীমান্ত— এগুলো সব মে মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত লকডাউন থাকবে। তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী তা বাড়বে বা কমবে।
আরও পড়ুন: বিশ্রী ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই আপনার এত কৌশল: ফের তীব্র আক্রমণে ধনখড়
ডেনমার্কের লোকজন এমনিতে বেশ স্বতঃস্ফূর্ত, সাহায্যকারী ও প্রাণোচ্ছল। কিন্তু এঁদের সংস্কৃতির আর একটা দিক সমান ভাবে সত্যি। প্রকৃতিগত ভাবেই এঁরা কিছুটা সামাজিক দূরত্ব মেনে থাকতে ভালবাসে। সাধারণত, কাজের ফিরে এরা বাড়িতে নিজেদের মধ্যে নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে ভালবাসে। কিন্তু এখন ইস্টার চলছে। এই সময় এবং ক্রিসমাসের ছুটিতে এঁরা জমায়েত, পার্টি, বেড়াতে ভালবাসে। যেটা সত্যি সবাই খুব মিস করছে।
লকডাউনের নিয়মকানুন ভালভাবে মানছেন ডেনমার্কের বাসিন্দারা।
আমি আর আমার অফিসের সহকর্মীরা এখানে আসার পর কিছুদিন একসঙ্গে ছিলাম। কিন্তু গত কয়েক মাস আগে থেকে সবাই আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে চলে গিয়েছি পরিবার নিয়ে আসব বলে। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য সবার মূল সমস্যা একাকিত্ব। কাজের পাশে যে যার মতো করে সময় কাটানোর চেষ্টা করছে। নিজেদের মধ্যে কফি টাইম, ভিডিও কনফারেন্স করছি মাঝে মাঝে, ভালো মন্দ শেয়ার হচ্ছে।
আরও পড়ুন: অনেক কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না, একাধিক গাফিলতির কথা তুলে রাজ্যকে চিঠি কেন্দ্রীয় দলের
ভারত ১৩০ কোটির দেশ হয়ে করোনার বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপগুলো করছে বা করেছে, যে ভাবে সামলাচ্ছে, আমরা সবাই সেটাকে সমর্থন করছি। শঙ্খধ্বনি থেকে শুরু করে অভূতপূর্ব নীরব দিওয়ালি, সবগুলো ঐক্যবদ্ধ হবার প্রচেষ্টায় আমরাও সবাই একসাথে আছি আর থাকব।
বাড়ির সবার সঙ্গে ভিডিও কলে রোজ যোগাযোগ আছে। আর সেটাই সবচেয়ে জরুরি ও প্রয়োজনীয় টনিক এই সময়। বাকি সময় অফিস-কাজ ছাড়া বিভিন্ন জিনিস নিয়ে সময়ে সময়ে নাড়াচাড়া করছি একঘেঁয়েমি থেকে বাঁচবার জন্য। যাঁরা পরিবার থেকে দূরে আছে, তাঁদের সবার মতোই প্রচণ্ড ভাবে মিস করছি। চেয়েও কাছে থাকার উপায় নেই।
আশা করি, সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতি করবে। সবার প্রচেষ্টায় করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে। তত দিন নিজের লোকদের বায়নাগুলো না হয় গুছিয়ে রেখে দিলাম।
অনির্বাণ বসাক
ভিবর্গ, ডেনমার্ক
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)