বেশ কিছু দিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতার বাঁ দিকে ছোট করে একটা খবর বেরিয়েছিল। ভারতের একটি শিল্পোন্নত রাজ্যে স্থির হয়েছে যে শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘন্টার পরিবর্তে বারো ঘণ্টা উৎপাদনের কাজ করবেন। সেই প্রসঙ্গে শিল্পপতিরা আর্জি জানিয়েছেন, বারো ঘণ্টা কাজ করালেও, তাঁরা আট ঘণ্টার টাকাই শ্রমিকদের দিতে চান, যাতে ব্যবসার ক্ষতি সামলানো যায়।
কয়েক দিন আগে একটি ওয়েব ম্যাগাজ়িনে খবর দেখলাম, দুটি বিমানসংস্থা তাদের বেশ কিছু কর্মচারীকে লিভ উইদাউট পে-তে যেতে নির্দেশ দিয়েছে, ক্ষতির ধাক্কা সামলানোর জন্য। এ ছাড়াও ইংল্যান্ডের একটি বিমান সংস্থা ১২ হাজার কর্মচারীকে ছাঁটাই করবে বলে স্থির করেছে। এই রাজ্যের অন্তত একটি টেক্সটাইল সংস্থার কথা আমি জানি, যারা ইতিমধ্যেই ভেবেছে, আগামী দু’মাস কর্মচারীদের বেতন না-ও দিতে পারে।
সবাই জানেন, এত ক্ষণ যা লিখলাম তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। এ রকম উদাহরণ প্রতি মূহূর্তে বিশ্ব জুড়ে তৈরি হচ্ছে ও হবে। যেটা উদ্বেগের, তা হল, আমাদের দেশে এই বিষয়টা নিয়ে কেন্দ্র বা অধিকাংশ রাজ্য স্তরে তেমন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের চিহ্ন এখনও অবধি দেখা যাচ্ছে না। ওপর ওপর শিল্পপতিদের একটা সাধারণ অনুরোধ করা হয়েছে মাত্র।
প্রশ্ন হল, এত দিন যখন ব্যবসা-বাণিজ্য ভাল চলেছে, তখন তো কর্মচারীরা কেবল বেতন ও প্রাপ্য বোনাসই পেয়েছেন। লাভের অংশ গিয়েছে শিল্পপতিদের ঘরে। তা হলে বিপদের সময় তা সামলানোর আর্থিক দায় কর্মচারীদের ওপর চাপানো হচ্ছে কেন ? এ কথা নিশ্চয় সবাই মানবেন, এক জন হরিপদ কেরানির ঘরে যত সঞ্চিত টাকা আছে, শিল্পপতির সঞ্চয়ের হার তার চেয়ে অনেক বেশি। প্রত্যেক শিল্পপতির কমবেশি ক্ষমতা আছে এই আর্থিক ধাক্কা সামলানোর। তাঁরা রিজ়ার্ভ ফান্ড ব্যবহার করতে পারেন, দরকারে ব্যবসায়ে নতুন পুঁজি ঢোকাতে পারেন। তবু, কোপ হরিপদ কেরানিদের ঘাড়েই।
সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর কী করা উচিত? অত্যন্ত কড়া ভাবে বলা উচিত, এই চরম বিপর্যয়ে কারও চাকরি খাওয়া চলবে না। বিরোধীদের সদর্থক আন্দোলনও এই ক্ষেত্রে আশা করা যেতেই পারে। কিন্তু বেশির ভাগ দল বা সরকার এটা করতে আগ্রহী নয়। কারণ, দল বা সরকার হরিপদ কেরানিরা চালায় না। চালায় শিল্পপতিদের অনুদান। কাজেই শিল্পপতিদের কেউ চটাবে না। আমরা ভাবি, সরকার আমরা বদল করি। ভুল! বাজার অর্থনীতিতে সরকার বদল করে মূলত বড় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো। ইতিহাস তার সাক্ষী।
তা হলে হরিপদ কেরানিদের করণীয় কী? এ বার একটু সংযত জীবন যাপন করা উচিত। বাজার অর্থনীতি আমাদের সামনে খুড়োর কল ঝোলাবেই, নানা লোভ দেখাবেই। বিজ্ঞাপনের মায়ায় নিজের আর্থিক ক্ষমতা ও ভবিষ্যতের চিন্তা ভুলে ভেসে যাওয়াটা বন্ধ করতে হবে। নিরাপদ ও নিয়মিত রক্ষণশীল সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকতে হবে, যাতে বিপদ এলে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারার কোমরের জোর থাকে। একটা কথা পরিষ্কার বুঝে নিতে হবে। বাজার অর্থনীতি মূলত সুসময়ের বন্ধু, দুঃসময়ে সে আমাদের ছুড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা করবে না। দোষটা তার নয়, এটাই তার চরিত্র। তার সঙ্গে মাখামাখির সময়ে যদি আমরা এটা ভুলে গিয়ে থাকি, বিপদে পড়ব।
সৌমিত্র চক্রবর্তী, হাওড়া
চিনের বিপদ
ভাগ্যিস করোনাভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব চিন দেশে হয়েছিল, তাই তো চিন আজ নতুন করে কমিউনিস্টত্ব ফিরে পেল! আমেরিকার রিপাবলিকান নেত্রী নিকি হ্যালি ‘স্টপ কমিউনিস্ট চায়না’ নামে একটি অনলাইন পিটিশনে চিনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আর্জি জানিয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসকে (‘আমেরিকায় মৃত্যু ছাড়াল ৫৩ হাজার’, ২৬-৪)। পিটিশনটি আমাদের দেশেও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল।
এত দিন ধরে শুনে এলাম চিন, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে ব্যর্থ সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। সমাজতন্ত্রের জায়গায় ড্যাংড্যাং করে ফিরে এসেছে সার্থক এবং নির্বিকল্প ধনতন্ত্র। এই মর্মে কত আনন্দ-উচ্ছ্বাস অহরহ ধ্বনিত হয় যাবতীয় প্রচারমাধ্যমে। তা, করোনার কল্যাণে চিনদেশে ফের সমাজতন্ত্রের ভূত নড়েচড়ে উঠল বুঝি!
একটা প্রবাদ আছে, কোনও কুকুরকে মারতে হলে তাকে পাগলা বলে দাগিয়ে দিতে হয়। আজকে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য-যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা তার এক নম্বর স্থানটি চিনের কাছে খোয়াতে চায় না বলেই কি চিনের গায়ে কমিউনিজ়মের তকমা সাঁটতে হচ্ছে?
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
অনলাইন পড়া
ব্যাপারটা এত দিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত গজর-গজরে সীমাবদ্ধ ছিল। মুশকিল হল, সম্প্রতি ব্যাপারটাকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবাদের একটা চেহারা দেওয়ার চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। একটা অনলাইন পত্রিকায় এক শিক্ষিকা এবং সমাজকর্মীর লেখা চোখে পড়ল, যাতে তিনি লকডাউন পিরিয়ডে সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনলাইন ক্লাস নেওয়া নিয়ে বিদ্রুপ শানিয়েছেন।
যুক্তিটা আপাত ভাবে শ্রুতিমধুর, কারণ তা গরিবদরদি। ঠিকই তো, যাদের স্মার্টফোন নেই, তারা কী ভাবে করবে এই অনলাইন ক্লাস? বিশেষত যখন এ রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোর অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই দারিদ্র-সীমার নীচে বাস করে। ব্যবস্থাটা বৈষম্যমূলক, সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যবস্থাটা আপৎকালীন। দু’মাস হতে চলল স্কুল, প্রাইভেট টিউশন, সবই বন্ধ। শিক্ষা এমন একটা প্রক্রিয়া, যা ধারাবাহিক অভ্যেসের ওপর নির্ভরশীল। তাই আপাতত যে ক’জনকে পাওয়া যাচ্ছে তাদের নিয়েই যদি চর্চাটা জারি রাখা যায়, ক্ষতি কী!
উল্লেখ্য, অনলাইন ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে কোনও সরকারি নির্দেশিকা জারি করা হয়নি। হলে, তা অবশ্যই অসঙ্গত হত। কারণ তাতে চিরাচরিত ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে এই আপৎকালীন বন্দোবস্ত বৈধতা পেয়ে যেত। এবং ভবিষ্যতে স্কুল খোলার পর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নতুন করে পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণ করার দায় থাকত না। কিন্তু এখন যাঁরা অনলাইন পড়াচ্ছেন, সেটা তাদের স্বেচ্ছাশ্রমের অতিরিক্ত কিছু নয়। যা কিছু তাঁরা অনলাইন পড়াচ্ছেন, স্কুল খোলার পর আবার সেগুলি নতুন করে পড়াতে তাঁরা বাধ্য থাকবেন।
কিন্তু, এই সিস্টেমে সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে একযোগে পাওয়া যাচ্ছে না— এই কারণ দেখিয়ে যদি ব্যবস্থাটাকেই বাতিল করে দেওয়া হয়, সেটা ভুল। কারণ, যে ছাত্রছাত্রীদের জন্য অকস্মাৎ আজ এই ‘সাম্যবাদ’ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, আবহমান কাল ধরেই তারা বঞ্চিত ছিল, আছে এবং থাকবে। অথচ ইতিপূর্বে তাদের জন্য এমন ‘কুম্ভীরাশ্রু’ ঝরেনি। আজ যে ছাত্র বা ছাত্রীটির স্মার্টফোন নেই বলে তাকে বঞ্চিত বলে মনে হচ্ছে, মাত্র দু’মাস আগেও তার পেটে ভাত ছিল কি না, বই-খাতা-কলম ছিল কি না, অর্থ উপার্জনের জন্য তাকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কোনও কাজ করতে হত কি না— তা এক বারও খোঁজ নিয়ে দেখার প্রয়োজন পড়েনি।
স্বাভাবিক সময়ে সচরাচর কত শতাংশ ছাত্রছাত্রী ক্লাস করে? এ রাজ্যের কোনও স্কুলের কোনও শ্রেণিতেই একটি সাধারণ শিক্ষাদিবসে ষাট-সত্তর শতাংশের বেশি ছেলেমেয়ে উপস্থিত থাকে না। তাদের একটা বড় অংশ আবার নিয়মিত ভাবেই গরহাজির থাকে। তা, সেই ছেলেমেয়েদের অনুপস্থিতি-জনিত কারণে কোনও দিন কোনও ক্লাস স্থগিত হয়েছে কি?
দেখেশুনে মনে হয়, এ আসলে সেই ‘বঞ্চনার ন্যারেটিভ’ তৈরি করে একাধারে দায়িত্ব এড়ানো এবং নিজেদের প্রগতিশীল প্রতিপন্ন করার চিরন্তন কৌশল। এক শ্রেণির বামপন্থী তাত্ত্বিক এই কাজটিতে অত্যন্ত দক্ষ। যে কোনও ভাল উদ্যোগেই এঁরা একদল ‘বঞ্চিত’-কে খুঁজে বার করেন, এবং তাদের শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়ে আড়াল থেকে অস্ত্রবর্ষণ করে উদ্যোগটিকে ভেস্তে দেন।
সীমান্ত গুহঠাকুরতা, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।