লকডাউন ওঠার পর ওসলোর সিটি সেন্টার ফাউন্টেন এলাকা। ছবি: লেখকের নিজস্ব।
আমার ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা, স্কুল সবই কোলাঘাটে। পড়াশুনোর জন্যই প্রথম বাড়ির বাইরে বেরোনো। তারপর অনেক এদিক ওদিক ঘুরে বর্তমানে নরওয়ের রাজধানী ওসলো শহরের বাসিন্দা। পেষায় আমি জীবরসায়নের গবেষক। ওসলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সেরে বর্তমানে পোস্টডক্টরেট করছি।
দেখতে দেখতে সাত বছর কাটিয়ে ফেললাম নরওয়ের এই ছোট্ট শহর ওসলোতে। বলতে দ্বিধা নেই, শুরুতে খুব কঠিন মনে হয়েছিল শহরটাকে। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় গোটা দেশটা ঢেকে থাকে বরফে, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। শীতকালে মাত্র কয়েক ঘণ্টা দিনের আলো থাকে, তার মধ্যে বেশির ভাগ সময়টাই কুয়াশাছন্ন। সূর্যের দেখা মেলা ভার। কখনও কখনও দেখা পাওয়া গেলেও মাত্র কিছু সময়ের জন্য। নরওয়ের উত্তরে ব্যাপারটা আরও সাঙ্ঘাতিক। তবে তুষারপাতের দৃশ্য খুবই মনোরম, অস্বীকার করার উপায় নেই।
খুব সাজানো গোছানো শহর এই ওসলো। দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুই যেন এক স্বতঃস্ফূর্ত নিয়মের মধ্যে চলে, ভাল লাগে। মানুষের ব্যবহার, সহনশীলতা, সৌহার্দতার তারিফ না করলে অকৃতজ্ঞতা হবে। একে অপরের সঙ্গে ভেদাভেদ বা বৈষম্য কোনও দিন চোখে পড়েনি। বিশ্বের খুশি এবং আনন্দময় দেশের তালিকায় প্রতিবছরই নরওয়ের অবস্থান প্রথম তিনের মধ্যে থাকে। বলতে পারেন, প্রেমে পড়ে গেছি এই শহরের।
বেশ কাটছিল। তখনও কেবা জানত করোনা নামক ভয়ঙ্কর ভাইরাসের কথা! চিন থেকে শুরু করে, বর্তমানে সারা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে একটা ছোট্ট আণুবীক্ষণিক জীব। তার ভয়ঙ্করতা তছনছ করে দিচ্ছে গোটা মানব সভ্যতাকে। না, নরওয়েও নিষ্কৃতি পায়নি। এই ছোট্ট দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যাও কয়েক শতাধিক। আতঙ্ক মানুষকে গ্রাস করে রেখেছে। জীবন রক্ষার তাগিদে সবাই ঘরবন্দি থেকেছেন।
আরও পড়ুন: সম্মানের সঙ্গে ত্রাণ বণ্টনের অভিনব পদ্ধতি, গোটা দেশে এমন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব
দীর্ঘ ৪০ দিন পর ২২ এপ্রিল লকডাউনের অবসান ঘটে। সে দিনই এই চিঠি লিখতি বসি। ঝাঁচকচকে রোদ্দুর আর নীল আকাশের ফাঁকে সাদা মেঘের লুকোচুরিতে, যেন এক নতুন বসন্তের সূচনা। চোখে পড়ছে চেরি ব্লুসমও। বেশকিছু পরিসেবা চালু হয়েছে, তবে অবশ্যই কঠোর বিধি-নিষেধ মেনে। তা আপাতত থাকবেও। তাই স্বাধীনভাবে অবাধ বিচরণ এখনও দূর অস্ত।
ওসলোর রাস্তাঘাট এখনও ফাঁকা। ছবি: লেখকের নিজস্ব।
রাস্তাঘাটে জনসমাগম তেমন একটা চোখে পড়ছে না। হয়তো আগামী সপ্তাহ থেকে আরও বেশি লোকজন দেখা মিলবে রাস্তায়। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও বিছিন্ন। এই এপ্রিলেই হয়তো সরকার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে। যে কোনও জনসমাবেশ বা বড় মাপের অনুষ্ঠান আপাতত বন্ধ। দোকানপাট, সুপার মার্কেট, গণপরিবহণ সব জায়গাতেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা বাধ্যতামূলক। পরিবারের বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে দেখা করা বা মেলামেশাতেও রয়েছে বিধি-নিষেধ, যেহেতু তাঁদের করোনার দ্বারা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। শুধু আউটডোর গেমসই নয়, জিম, ইনডোর অ্যাক্টিভিটিও আপাতত বন্ধ। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে ধীরে ধীরে সব বিধি-নিষেধ শিথিল করা হবে বলে সরকার জানিয়েছে।
করোনা মোকাবিলায় নরওয়ের সাফল্য ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ ভাল। শুরু থেকেই এখানে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করেছে। সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সবাই ব্যক্তিগত স্বার্থ সরিয়ে রেখে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করোনার মোকাবিলা করে গিয়েছেন, এখনও করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র নির্দেশিকা পালন করে যথা সময়ে লকডাউন, পর্যাপ্ত নমুনা পরীক্ষা, করোনা আক্রান্তদের আলাদা করে চিকিৎসা ব্যবস্থা, সব কিছুতেই তৎপরতা দেখিয়েছে নরওয়ে সরকার। দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে করোনা পরীক্ষার সংখ্যায় নরওয়ে বিশ্বের প্রথম সারিতে। নরওয়েবাসীদের মতে সরকারের এমন দায়িত্ববোধই সাফল্যের মূল কারণ। স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দাবি, এখনও কিছু পজিটিভ রিপোর্ট আসছে। কিন্তু তাতেও উদ্বেগের কোনও কারণ নেই, নরওয়ের করোনা সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে।
আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্ত মায়ের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে দেখা ৬ দিনের শিশুর
শুধু মানবসভ্যতাই নয়, বিশ্ব অর্থনীতিকেও চুরমার করে দিচ্ছে করোনা অতিমারি। নরওয়ে সরকারও ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক কষতে ব্যাস্ত। বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাপের বেসরকারি সংস্থাগুলির জন্য বিশেষ শুল্ক ছাড়ের কথা বলা হয়েছে। সরকারি সহযোগিতায় লক্ষাধিক মানুষ এখন সাময়িকভাবে কর্মহীন। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীগুলোকে বিশেষ ছাড়ের আওতায় আনা হয়েছে। এমনিতে নরওয়ের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বেশ শক্তিশালী। তাই কয়েক মাসের মধ্যেই দেশ আবার অর্থনৈতিক মূলস্রোতে ফিরবে বলে সরকারের বিশ্বাস।
আমার মেয়ের ডে কেয়ার ২২ এপ্রিল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। নিয়মকানুন আর বিধিনিষেধের একটা লম্বা লিস্ট আগেই পাঠানো হয়েছিল ডে কেয়ার থেকে। আর সেই মতোই তার প্রস্তুতি। ব্যাগের মধ্যে আলাদা আলাদা প্যাকেটে দু-তিনটে জামাকাপড়, দুটো জলের বোতল, দুটো টিফিনকৌটো ছাড়াও আরও নানান জিনিসপত্র। ছোটো ছোটো গ্রুপে বাচ্চাদের ভাগ করে দেওয়া নিয়ে যাওয়া আসা হচ্ছে। প্রতি গ্রুপে চার জন, সঙ্গে এক জন শিক্ষক। পরিস্থিতির মোকাবিলায় ডে কেয়ারের সময়সীমাও অনেকটা কমানো হয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ও খুলতে শুরু করছে। সব জায়গাতেই নানান বিধিনিষেধ। ল্যাবরেটরিতে এক সঙ্গে দু’জনের বেশf কাজ করার অনুমতি নেই।
বাড়িতে বাড়িতে জানলার কাচে হাতে আঁকা রামধনুর ছবিতে লেখা থাকতো- ‘একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে’। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আজ আমরা ফিরে পেয়েছি সেই দিনটাকে। নরওয়েবাসীর কাছে এটা নতুন বসন্ত ছাড়া আর কি হতে পারে! প্রিয় ঋতু গ্রীষ্ম দরজায় কড়া নাড়ছে এক নতুন বার্তা নিয়ে। আবার গোটা দেশ ফিরে আসবে তার চেনা ছন্দে। কলরব কোলাহলে ভরে উঠবে গোটা শহর, গোটা দেশ।
নরওয়ে থেকে করোনা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি ঠিকই, কিন্তু এই যুদ্ধের বেশির ভাগটাই আমরা জিতে ফেলেছি। বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথা ভারতবর্ষের কথা ভেবে খুব উদ্বেগ হয়। আমার মা-বাবা, দিদি-বোন, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব সবাই কোলাঘাট, কলকাতা বা তার আশপাশেই থাকেন। তাঁরাও চিন্তিত।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা করোনাকে জয় করবোই। ভারতেও নতুন সূর্যোদয় হবে। রামধনুর রঙে ঝলমল করবে গোটা দেশ। শুধু সময়ের অপেক্ষা। সবাই ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন।
দীপঙ্কর মান্না
গবেষক, ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়, নরওয়ে
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানা ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের সঙ্গে। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা, তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি প্রকাশযোগ্য বলে বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)