সুনসান মেক্সিকোর রাস্তা। —নিজস্ব চিত্র।
কোভিড ১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা ৪.৩ লক্ষ পেরিয়ে গিয়েছে আমেরিকায়। তারই প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটি-তে আটকে পড়েছি কোভিড ১৯-এর জন্য।
কর্মসূত্রেই আমার মেক্সিকো আসা এবং এটিই ছিল আমার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তাই এখানে আসার আগে উত্তেজনাও ছিল সেরকম। ফিরে যাওয়ার কথা ছিল ৪ এপ্রিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য আটকে পড়েছি এখানে।
এখানে আসার পর প্রথম এক মাস বেশ কিছু জায়গায় ঘুরি। শহর ও দেশটাকে জানতে ও চিনতে শুরু করি। ছবির মতো সুন্দর এবং গোছানো রাজধানী শহর। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা, তাই আবহাওয়া বেশ মনোরম। এর সঙ্গেই যেটা উপলব্ধি করি সেটা হল এখানকার মানুষ সব সময় আনন্দ করে,পার্টি করে, জীবন উপভোগ করতে ভালবাসে। শহরের প্রাণকেন্দ্র জোকালোতে দিনের সব সময়েই ভিড় লেগে থাকে এবং সেখানে নানা অনুষ্ঠান, গানবাজনা চলতে থাকে সারাক্ষণ। জায়গাটা আমার হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ।
আরও পড়ুন: করোনা উপসর্গ থাকা রোগীর মৃত্যু, দেহ নিতে অস্বীকার পরিবারের, আতঙ্ক মেডিক্যালে
এ ভাবে প্রথম এক মাস কাটার পরে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় খবরে শুনলাম মেক্সিকোর প্রথম কোভিড ১৯ আক্রান্তের কথা। তার পরের ক’ দিনে আরও কিছুটা বাড়ল সংখ্যাটা এবং সারা বিশ্বে তত দিনে ছবিটা বেশ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। আশ্চর্য ভাবে দেখলাম মেক্সিকো সরকার ততটা গুরুত্ব দিতে নারাজ এই বিষয়টিকে। স্থানীয় মানুষ ও আমার অফিসের সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, সরকার এখানে কোনও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বা পরবর্তী কালে লকডাউনের মতো কোনও পদক্ষেপ করতে চাইছে না।
কারণ হিসেবে যেটা বুঝলাম, তা হল মেক্সিকোয় দিন আনা দিন খাওয়া এমন বহু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা লকডাউন হলে আরও অসুবিধায় পড়বেন। যা অনভিপ্রেত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। মেক্সিকোর মানুষের আনন্দ, উল্লাস করার দৈনন্দিন অভ্যাসে সরকার হস্তক্ষেপ করতে চাইছিল না।
এই সব দেখে বুঝতে পারলাম, নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য নিজেকেই ভাবতে হবে। সুতরাং শুরু করলাম সেল্ফ আইসোলেশন। কারণ মেক্সিকোর জন ঘনত্ব আর মেডিক্যাল সিস্টেমকে মাথায় রেখে সেল্ফ আইসোলেশন ছাড়া উপায় ছিল না। অগত্যা গত ৭ মার্চ থেকে হোটেলের সুইট-এ নিজেকে বন্দি করে রেখেছি। হয়তো ১৫ দিনে একবার বেরোচ্ছি কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে। এখানকার সব চেনা মানুষদের সেল্ফ আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং সম্পর্কে অবহিত করার চেষ্টা চালাচ্ছি।
মেক্সিকো সরকার এখন কোভিড ১৯-এর ভয়াবহতার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বেশ কিছু পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে। বর্তমানে বিনোদনের সব জায়গা,পার্ক, সিনেমা হল ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুনছি মেক্সিকো সরকার আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশের আকাশপথ বন্ধ করে দেবে পুরোপুরিভাবে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে পুলিশ সতর্কতামূলক প্রচার চালাচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে প্রতিদিন বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলন করে দেশের অবস্থা এবং কোভিড ১৯-এর সামগ্রিক পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির চাকা কীভাবে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা চলছে।
বর্তমান সপ্তাহটি মেক্সিকোর ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সপ্তাহ। মেক্সিকোতে এটি ইস্টার সপ্তাহ বা পবিত্র সপ্তাহ নামে পরিচিত। এই পুরো সপ্তাহ এখানকার মানুষ আনন্দ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে উদযাপন করে থাকে। কিন্তু এ বার কোভিড ১৯-এর প্রভাব পড়েছে উৎসবেও। অন্য বারের তুলনায় শহর সেজে ওঠেনি, সব জায়গা ফাঁকা আর মানুষ সচেতন হয়ে নিজেকে গৃহবন্দি রাখতে শুরু করেছে। গত ৩-৪ দিনে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যাটাও উল্লেখযোগ্যভাবে কম। জোকালো-ও ফাঁকা এবং নিস্তব্ধ।
আরও পড়ুন: ঘোষণার সাত দিন আগেই লকডাউন সেনবাড়িতে! তাক লাগাচ্ছে দুই খুদেও
ও দিকে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার বাড়িতে রয়েছেন মা-বাবা আর প্রিয় পোষ্য। সম্পূর্ণ বিপরীত টাইম জোনে বসে ওঁদের নিয়েও চিন্তায় রয়েছি। কারণ বাবা-মায়ের গড় বয়স প্রায় ৬০ বছর। না চাইলেও, দরকারে ওঁদের বাড়ির বাইরে যেতেই হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আজ পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় যোগাযোগ বেশ সহজ হয়েছে আর সেটার ভরসাতেই বাড়ির লোকের সঙ্গে সব সময়ে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
যে ভাবে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোভিড ১৯-কে পরাস্ত করার যজ্ঞে সহযোগিতা করছে, পরিকল্পনা করছে, তার জন্য আমাদের দেশ, রাজ্য সরকার ও পুলিশকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। মেক্সিকোয় ইন্ডিয়ান এমব্যাসি আমাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছে এবং আমার কোম্পানিও আমার পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আকাশপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা থেকে এখানে আটকে পড়া ভারতীয়রা, এমব্যাসিতে যোগাযোগ করছে কোনও স্পেশ্যাল উড়ানের ব্যবস্থা করার জন্য। যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে যাওয়া যায়।
মন খারাপ, চিন্তা আর উদ্বেগের কালো মেঘ মাথায় নিয়েই আশা রাখছি খুব তাড়াতাড়ি এই পরিস্থিতি আমরা কাটিয়ে উঠবো। সারা বিশ্বে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে। আমি এবং আমার মতো বাকিরাও যে যাঁর দেশে ফিরতে পারব। দেশে ফিরে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে পরবর্তী পদক্ষেপ হবে কোনও কোয়রান্টিন সেন্টারে অন্তত ১৫ দিন নিজেকে অবজারভেশনে রাখা। সবাই সুস্থ থাকুন, ঘরে থাকুন, সরকার যা অনুরোধ করছে, সে গুলো মেনে চলুন। তা হলেই এই মহামারিকে আমরা পরাস্ত করতে পারব। উই শ্যাল ওভারকাম।
সৈকত সাঁতরা। মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকো।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)