পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর রাস্তায় বেরিয়েছে গাড়ি। ছবি: লেখকের পাঠানো ভইডিয়ো থেকে নেওয়া।
সবাই জানেন যে, দক্ষিণ কোরিয়ার ডেগু শহর করোনা মহামারির উপকেন্দ্র। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এই শহর ছিল চিনের বাইরে প্রথম কোনও শহর, যেখানে করোনা পজিটিভের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। প্রায় ন’বছর এই শহরে রয়েছি স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে। আমি এখানকার একটা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক। ১৯ ফেব্রুয়ারি যখন প্রথম খবর পাই ডেগু শহরে তীব্র গতিতে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে, খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। শুনলাম এক জন ৬১ বছরের মহিলা (যাঁকে পেশেন্ট ৩১ বলা হচ্ছে)-র থেকে এই শহরে এবং বাইরেও অনেকের মধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়ে গিয়েছে। অত্যন্ত সংগঠিত, শান্ত অথচ গতিশীল শহর এই ডেগু। কিন্তু ওই দিন থেকেই লোকজনের মধ্যে চাঞ্চল্য অনুভব করি। স্যানিটাইজার কেনার ধুম পড়ে যায়। এখানে যেহেতু সারা বছরই লোকজন মাস্ক পরে থাকেন, তাই শুরুতে মাস্ক কেনার ঝোঁক কম ছিল। কারণ হাওয়ার গতির উপর নির্ভর করে মাঝে মধ্যেই চিন থেকে ইয়ালো ডাস্ট এ দিকে চলে আসে। তখন মোবাইলে ইন্টিমেশন দেয় বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কত। সেই মতো মাস্ক পরার সতর্কতা জারি হয়। তাই আমাদের বাড়িতে যথেষ্ট পরিমাণ মাস্ক রাখাও ছিল। কিন্তু স্যানিটাইজার কিনতে গিয়ে শুনলাম, যে পেশেন্ট ৩১-র কথা বলা হচ্ছে, তিনি একটি চার্চের সঙ্গে জড়িত, যার ডেগু শাখা থেকে করোনাভাইরাস চারিদিকে ছড়িয়েছে। ওই শাখাটি আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে মাত্র ১০-১২ কিলোমিটার দূরে।
স্বাভাবিক ভাবেই বেশ চিন্তায় ছিলাম। ২০ ফেব্রুয়ারি আমার বড় মেয়ের ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং ছোট মেয়ের কোরিয়ান প্লেস্কুল বন্ধ হয়ে যায়। আমার ইউনিভার্সিটির সেমেস্টার দু’সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরবর্তী দু’দিনে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা প্রায় দশ গুণ বেড়ে যায়। বিদেশি, বিশেষ করে এখানকার ভারতীয়দের মধ্যে একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ছাত্রই আমার পরামর্শ চায় ভারতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে, কারণ সে সময় ভারতে করোনা পজিটিভ কেস ছিল মাত্র তিনটি। স্বাভাবিক ভাবেই আমি বিষয়টা সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার উপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। অনেকেই ফিরে যায়। ভারতে আত্মীয়রাও আমাকে দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমি আমার কোরিয়ান সহকর্মীদের দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কারণ এই পরিস্থিতি নিয়ে ভীষণ ভাবে স্বাভাবিক ছিলেন। আমাকে তাঁরা জানিয়েছিলেন, তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে সবটাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শুধুমাত্র আইসোলেশনে থাকতে হবে।
এর পরবর্তী দু’সপ্তাহে ডেগু শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। অথচ প্রশাসনের তরফে লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। শুধু বাড়িতে থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটা নাগরিক সেটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। গণ পরিবহনও স্বাভাবিক ছিল। যদিও তাতে যাত্রী প্রায় শূন্য ছিল। বাইরে গেলে নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করেছেন। বড় বড় শপিং মল, সিনেমা হল, দোকান, সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু খোলা রাখা হয় ছোট দোকান, ফার্মেসি। পরবর্তী তিন সপ্তাহ সম্পূর্ণ বাড়িতে। ডেগুতেই করোনা পজিটিভের সংখ্যা সাত হাজার ছাড়িয়েছে। আমাদের এলাকার ১০-১২ জনকে আমাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রতি দিনই মোবাইলে ইন্টিমেশন আসছে, বিভিন্ন করোনা পজিটিভের লোকাল ট্রাভেল হিস্ট্রি নিয়ে। সেই রোগী কবে, কত নম্বর বাসে কোথায় গিয়েছিলেন, তার তথ্য দিয়ে। যাতে তাঁর সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের চিহ্নিত করে আইসোলেশনে থাকেন। সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং কোরিয়ানরা কেন এত শান্ত তা বুঝেছিলাম। ঠিক চার সপ্তাহের মধ্যেই করোনা গ্রাফটাকে ফ্ল্যাট করে দিতে সক্ষম হন এঁরা। আজ ডেগু শহর প্রায় স্বাভাবিক। লোকজন বাইরে বার হচ্ছেন। অফিস খুলে গিয়েছে। স্কুল-কলেজে অনলাইন ক্লাস চলছে। পুরো স্বাভাবিক হতে আরও অন্তত দু-তিন সপ্তাহ লাগবে। তবে করোনা সংক্রমণের চেনটা ভেঙে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: নেগেটিভ রেজাল্ট যে এত পজিটিভ হতে পারে এই জানলাম
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এখানে যেমনটা ছিল, ভারতে এখন ঠিক সেই পর্যায়। ভারতীয়রা যদি সরকারের উপর আস্থা রাখেন, সব পরামর্শ মেনে চলেন, তা হলে আমি আশাবাদী যে, ভারতে এই অতিমারি বেশি দূর ছড়াবে না। ফের সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
অর্ঘ্যনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ডেগু, দক্ষিণ কোরিয়া
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)