সম্পাদকীয় ‘ফস্কা গেরো’ (৬-৯) প্রসঙ্গে কিছু কথা। নাগরিকদের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই এই মাসের গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হল ‘অপরাজিতা মহিলা ও শিশু (পশ্চিমবঙ্গ ফৌজদারি আইন সংশোধন) বিল, ২০২৪’। বিরোধী দলনেতা বিলটিকে সমর্থন জানিয়ে কয়েকটি সংশোধনী এনেছেন। সম্পাদকীয়ের মতের সঙ্গে সহমত পোষণ করি যে, বিলটি নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে আলোচনা হলে অনেক দিক উঠে আসতে পারত। আমাদের দেশে আইন প্রণয়নের ভার যাঁদের উপর, তাঁরা অনেক সময়ই ভেবে থাকেন, তাঁদের ভাবনাটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাবনা। যদিও অনেক সময়ই তা দলীয় ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে ফাঁসি রাখা নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। যেমন, পৃথিবীর বহু দেশে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আছে, আবার বহু দেশে তা নেই। যেখানে মৃত্যুদণ্ড আছে, সেখানে কি এর ফলে ধর্ষণের সংখ্যা কমেছে? ধর্ষণের চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড তো ভারতেও আছে, কিন্তু তথ্য বলছে, ২০২০ অপেক্ষা ২০২১ সালে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে তিন হাজারের বেশি, এবং প্রতি দিন এ দেশে ধর্ষণের সংখ্যা গড়ে ৮৬টি।
ভারতে ২০১২ সালে নির্ভয়া-র মৃত্যুর পর আনা আইনে এবং ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ২০২৪ আইনেও ধর্ষণের শাস্তি কঠোর করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও, একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এ দেশে। ধর্ষণ হলেই ফাঁসি হবে, এটি জানা থাকলে ধর্ষণকারী আক্রোশবশত ধর্ষিতাকে মেরে ফেলতে পারেন এবং সেই সম্ভাবনা যথেষ্ট। ধর্ষণকারী যদি নিজের পরিবারের কেউ হন বা নিকটাত্মীয় কেউ হন, তা হলে আত্মীয় বিয়োগের চিন্তায় নির্যাতিতা অপরাধীর নাম প্রকাশ না-ও করতে পারেন। কখনও যদি বিচার প্রক্রিয়ায় কোনও ত্রুটি থেকে যায়, ফাঁসি হয়ে গেলে সেই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ আর থাকে না। না শাসক দল, না বিরোধী দল— কোনও পক্ষের তরফ থেকেই এই সকল প্রশ্ন নিয়ে কোনও আলোচনাই শুনলাম না।
প্রশান্ত দাস, খলিসানি, হুগলি
সামনের পথ
আমরা অনেক দুর্নীতি দেখেও পাশ কাটিয়েছি। শিক্ষক নিয়োগে, রেশন ব্যবস্থায়, গরু, কয়লা, বালি, মাটি পাচারে, মিউনিসিপ্যালিটির নিয়োগে দুর্নীতির সাক্ষী ও ভুক্তভোগী তো আমরাই, অর্থাৎ রাজ্যবাসী। কিন্তু আমরা কি ততখানি উদ্বিগ্ন হয়েছি? আমাদের চোখের সামনেই তো রাজপথে দিনের পর দিন অবস্থান করেছেন আমাদের সন্তান, ভাই বা বোনেরা। রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে ছাত্র সংগঠনের নির্বাচন না করা, মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া কর্পোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটিতে নির্বাচন না করে প্রশাসক নিয়োগ, এ সবই তো গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আমাদের সীমাহীন উদাসীনতায় শাসক প্রশ্রয় পেয়েছেন। এখনই এর বিহিত প্রয়োজন, প্রয়োজন জোরালো প্রতিবাদের। তাই তাঁরা প্রাণপণ লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছেন সবাই।
নারী-নিরাপত্তার প্রশ্নটিতে নতুনত্ব কিছু না থাকলেও তাকে আর গা-সওয়া গোছের করে রাখতে রাজি নয় কেউ। নিজের কন্যাসন্তানের মতোই, প্রতিবেশীর ঘরের কন্যাটিও অনাগত নির্যাতনের আতঙ্কে নিদ্রাবিহীন। সরকারি স্তরে এক দিকে যেমন অভয়ার নির্যাতন ও মৃত্যুর ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, অন্য দিকে সামাজিক হুমকির দৃষ্টান্তও কম কিছু নয়। গণতান্ত্রিকতার খোলসটিকে অস্বীকার করার দুঃসাহস না দেখিয়েও যে চাপা সন্ত্রাসের পরিবেশ অব্যাহত রাখা যায়, বর্তমান সময় তার সাক্ষী। এই প্রচেষ্টা জারি থাকবে। নেওয়া হবে নানা কৌশল। সুতরাং, জনসাধারণ যখন এক বার আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে সোৎসাহে এগিয়ে এসেছেন, তখন সেই সংহত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
বরুণ কর, ব্যান্ডেল, হুগলি
ব্যক্তি রাজনীতি
‘নিজের গলাটা ছাড়তে হবে’ (৩১-৮) শীর্ষক সেমন্তী ঘোষের প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। রাজনীতির আঙ্গিকে ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ মিলেমিশে থাকলে ভোট ও ক্ষমতার বাইরে সমাজ দেখার, বোঝার, গড়ার সমবেত কর্তব্যের সার্বিক মনোভঙ্গি গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু ‘রাজনীতি’ বলতে রাজনৈতিক দল বোঝে সরকারি ক্ষমতা দখল করা, ভোটের মাধ্যমে। বিপক্ষকে হেয় করা, দুয়ো দেওয়া এবং মিছিল, বিক্ষোভ, ধর্না, অবরোধ, ধর্মঘট— এ সবই হল ভোটের লড়াইয়ের উপকরণ। জনগণের জন্য আছে নির্দিষ্ট ভূমিকা— ভোটদান। ফলাফল শেষে ব্যক্তির ভোটার পরিচয়ের প্রয়োজন থাকে না, তাঁর আর নিজস্ব কোনও ‘ব্যক্তি রাজনীতি’ নেই। ভোটার জনগণের অংশ হলেও এখান থেকে নিঃসঙ্গ। আর একটা ভোট পর্যন্ত ক্ষমতা রক্ষা বা দখল, এবং তার জন্য জনমতকে প্রভাবিত বা প্ররোচিত করা ছাড়া শাসক ও বিরোধী দলের অন্য কোনও ভূমিকা নেই।
‘সামাজিক সাধ্য’ গড়ে তোলা ও তাকে কাজে লাগিয়ে সমাজ সচেতনতা, এগুলি আসলে নির্মাণ রাজনীতির কথা। কেবল ‘বিচার চাই’ ধ্বনিতে চাপা পড়ে যেন না যায় এই জরুরি উচ্চারণ। প্রথমত বিচার অবশ্যই চাই, তার সঙ্গে চাই এই বিষবৃক্ষের উৎপাটন। আর জি কর কাণ্ড থেকে অন্যান্য দুরাচার, নারকীয় ঘটনার নেপথ্যে যেমন থাকে সরকারের অব্যবস্থাপনা, প্রশ্রয়, অপদার্থতা, অন্য দিকে তেমনই জনগণের প্রান্তে থাকে কর্তব্য-বিমূঢ়তা। কারণ ভোট দেওয়া ছাড়া জনগণের কর্তব্যের কোনও ‘সিলেবাস’ নেই। চরম কিছু না ঘটা পর্যন্ত চলে নীরবতা। এই সরকার, বিরোধী দল ও গণপক্ষ— এই ত্রয়ীর সমবায়েই এই নরকের নকশা।
চরম অব্যবস্থাপনার পরিণতিতে যে-হেতু অবিচার ঘটে, তাই অবিচারের গোড়ায় যেতে হবে। মানসিকতা, পরিকাঠামো, লিঙ্গসমতা, সমসুযোগ প্রতিষ্ঠার দাবি রাখতে হবে। যে পাঠ হাওড়া তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের প্রধান শিক্ষিকা তাঁর ছাত্রীদের দিচ্ছেন। ভোট দেওয়ার আগে-পরে তার চর্চা চাই।
মানস দেব, কলকাতা-৩৬
মনের তাগিদ
আমি রক্ষণশীল পরিবারের ষাটোর্ধ্ব গৃহবধূ। আজ পর্যন্ত কোনও মিটিং-মিছিলে হাঁটিনি। গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম কলকাতায় রাতের মিছিলে হাঁটলাম। হাঁটলাম নিজের মনের তাগিদে। আর জি করে ধর্ষণ ও খুনের বিচারের দাবিতে। মিছিলে যারা হাঁটছিলেন, তাঁরা কেউ আমার আত্মীয় নন, পরিচিত নন, বন্ধুবান্ধব নন। তবু মনে হচ্ছিল তাঁরা আমার কত আপনজন। গড়িয়া থেকে যাদবপুর হাঁটতে দেখে অনেকে জলের বোতল এগিয়ে দিচ্ছিলেন, আমাকে গাড়িতে উঠতে বলছিলেন। আমি হাঁটতে পেরেছি কারণ সেই মেয়েটির মুখটা আমার সঙ্গে ছিল। আমি হাঁটছিলাম, কারণ আমার রাগ হচ্ছিল সেই ধর্ষণকারীর উপর, আমার রাগ হচ্ছিল সেই সব পুলিশ আর ডাক্তারের উপর যাঁরা ধর্ষণের পরিবেশ তৈরি করেছিলেন, আর সেই সব লোকের উপরে যারা তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছিল।
অবাক লাগে, এক জন মেয়ে নিজের জীবন দিয়ে আমাদের বাঁচার পথ দেখাচ্ছে। অন্যায় সহ্য করতে করতে আমরা যখন প্রতিবাদের ভাষা ভুলেই গিয়েছিলাম, তখন সেই মেয়েই তো আমাদের টেনে পথে নামাল। বুকের ভিতর থেকে ডাক পেলাম। আমাদের পিছোবার পথ নেই। অপরাজিতা বিল এনে কী হবে? আসামিকে ফাঁসির দড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবে কে? পুলিশ উকিল প্রশাসন। এখানে পুলিশ প্রমাণ লোপাট করছে, সরকার-নিযুক্ত উকিল অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করছেন। আর প্রশাসন বলছে, আনন্দ করো। তবে সবার উপরে মানুষ সত্য, তাই বিবেকের ডাকে লক্ষ মানুষের এই রাস্তায় নামা। এখনও যদি না নামি, হয়তো মরার সময়ে মনে হবে, আমরা আদৌ বেঁচে ছিলাম তো?
মিতালি মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪