‘প্রসূতির মৃত্যু’ (৩-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধের শেষ লাইনটি দেখে বিবেকবান নাগরিকের চোখে জল এসে যাবে। ভারত প্রসূতি মৃত্যু রোধে উদ্যোগী হতে শুরু করে ২০০০ সাল থেকে, যে বছর ‘মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোলস’-এ ভারত স্বাক্ষর করে। ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের বেশ কিছু উন্নয়নের সূচক বৃদ্ধির শর্ত সেখানে থাকে। তার মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ও শিশুমৃত্যুর হার অন্যতম। এই সূচকগুলি উন্নত করতে না পারলে ভারত উন্নত দেশের তকমা পাবে না। রাষ্ট্র পরিচালকদের মানবিক উদ্দেশ্যের চেয়ে অনেক বেশি তাগিদ ছিল উন্নত দেশের তকমা। তবু মাতৃমৃত্যুতে আমরা আজও বিশ্বের প্রথম দশে! মানবিকতা ছাড়া কি সুরক্ষিত মাতৃত্ব, নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করা যায়?
হাজারো ঢাক-ঢোল পেটালেও মাতৃমৃত্যু কমল না। ২০১৫ সালে সূচনা হল ‘সাসটেনেবল ডেভলপমেন্ট গোলস’-এর, ঘোষণা হল ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত, অর্থাৎ ১ লক্ষ জীবন্ত প্রসবের ক্ষেত্রে ৭০ জনের বেশি মা যেন মারা না যায়। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে ২০২০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল এক লক্ষ প্রসবে ১০০ মৃত্যু। আজও তা অধরা, কারণ যেটুকু কমতে শুরু করেছিল, তা আবার বাড়তে শুরু করল। যেমন ২০২২-২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রসবজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছিল ১১১২ জনের। ২০২৩-২৪ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬২ জন। আর এ বছর এপ্রিল, মে, জুন এই তিন মাসের মধ্যেই প্রসবজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে ৩১১ জনের। বছর শেষে সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা যে কোনও চিন্তাশীল মানুষকেই ভাবিয়ে তুলছে।
প্রথম দিকে সরকার প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের উপর জোর দিয়েছিল। তাতে অবশ্যই কিছু মৃত্যু আটকানো গেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলির পরিকাঠামোগত মান এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা না বাড়িয়ে কি আর প্রসূতি মৃত্যু আটকানো যায়? তথ্যই তা প্রমাণ করছে! ঝাঁ-চকচকে বাড়িবিশিষ্ট সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল কিংবা জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিলেই যে উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায় না, কেবল মাতৃমৃত্যুর হারই তা প্রমাণ করে দেয়।
সজল বিশ্বাস, সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম
বাংলার স্বীকৃতি
বিশ্বজিৎ রায়ের ‘যে পথে ভাষা-সমন্বয়’ (১১-৮) প্রসঙ্গে এই পত্র। প্রবন্ধকারের একটা কথা একটু বিপরীত ভাবে বললে যা দাঁড়ায় তা হল রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাবনায় আটকে থাকার দায় নেই। সে জন্য “নিজের এক সময়ের মতকে নিজের অস্তিত্ব বলে ভাবার মতো আত্মরতিময় তিনি ছিলেন না!” ঠিক কথা। সে জন্য একাধিক লেখায় তাঁর একাধিক মত— অন্তত ভাষার সমস্যার সমাধান সম্পর্কে— পাওয়া যায়। ভাষা-সমন্বয়ের প্রসঙ্গটি দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ইংরেজি প্রবন্ধে অনেকখানি আলোচনা করেছেন অনেক আগেই, নাম ‘ল্যাঙ্গুয়েজ-প্ল্যানার রবীন্দ্রনাথ’। এই প্রবন্ধে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘পিসফুল কো-এগজ়িস্টেন্স অব ল্যাঙ্গুয়েজেস’-এর ধারণা উল্লেখ ও আলোচনা করেছেন।
প্রবন্ধের শুরুতে লেখক আভাস দিয়েছেন, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ইংরেজিকে শিখণ্ডী দাঁড় করিয়ে হিন্দি আধিপত্যকে আড়াল করার চেষ্টা বহু কাল আগে থেকেই চলছে। হিন্দি যে রাষ্ট্রভাষার সমগোত্রীয় কিছু একটা, তা শতকরা ৪৩ ভাগ হিন্দিভাষী ভারতীয়ের একাংশ প্রমাণ করতে আজও সচেষ্ট। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও এক সময় হিন্দিকে ‘লিঙ্গুয়া ইন্ডিকা’ করার প্রস্তাব দিয়ে সমর্থনও করেছিলেন, তার পর এই ভাষার সাম্রাজ্যবাদ লক্ষ করে তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা-বিচ্ছেদ’ প্রবন্ধে যে ওড়িয়া ও অসমিয়াকে বাংলা ভাষার উপভাষা ভেবে ভাষাগত সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন, তা ভুল ছিল। তা সত্ত্বেও আজকে অন্তত একটা বিষয় ভাবা দরকার। ওড়িয়া দেড় হাজার বছরের পুরনো ভাষা সংস্কৃতি হিসাবে প্রমাণ করে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি আদায় করতে পারে। অথচ, যাকে তিনি মূল ভাষা হিসাবে ভেবেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ-কর্ষিত সেই বাংলা ভাষা আজও ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পায়নি।
শ্যামলচন্দ্র দাস,রামপুরহাট, বীরভূম
বেহাল দশা
‘স্মার্ট হাসপাতাল’ (১১-৮) শীর্ষক সংবাদটি প্রসঙ্গে বলতে চাই, ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের বেহাল দশা। ভাটপাড়া পুর এলাকার হাজার হাজার বাসিন্দার কাছে এটি ‘রেফার’ হাসপাতাল বলেই পরিচিত। ভোটের আগে অনেক নেতাই বহু বার এই হাসপাতালের হাল ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে জিতলে কেউই হাসপাতালের উন্নয়নের দিকে নজর দেননি। ব্যারাকপুর থেকে নির্বাচিত সাংসদ পার্থ ভৌমিক সাংসদ কোটার থেকে চার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন শুনে অনেকে নাগরিকই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। এখানে জরুরি চিকিৎসা বেশির ভাগ সময় মেলেই না। নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতিও তেমন নেই। পর্যাপ্ত সংখ্যায় চিকিৎসকও নেই। সুবিশাল ৩৫টি ওয়র্ড বিশিষ্ট হাসপাতালে বর্তমানে ডাক্তার মাত্র ২৪ জন। মহিলা ও পুরুষ উভয় বিভাগের ঘরে ঘরে বেডের তলায় ও আশপাশে যত্রতত্র বিড়াল ও কুকুর ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। অথচ, ভাটপাড়ায় আর কোনও বড় সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল নেই।
উনিশ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই হাসপাতালের বহু জায়গা খালি, আগাছায় ভর্তি। রাতের দিকে সেখানে নেশার আসর বসে। সন্ধ্যা নামলে হাসপাতাল চত্বরে বহিরাগতদের আনাগোনাও চোখে পড়ে। রোগীর আত্মীয়দের জন্য রাত্রিবাসের সুবিধাটুকু নেই। শৌচাগারের হালও খুবই খারাপ। হাসপাতালের চার পাশে আলোর সুবন্দোবস্ত নেই। নিরাপত্তার অভাব রয়েছে, বিশেষ করে মহিলাদের জন্য। সঠিক ভাবে পরিকল্পনা করলে সরকারি সহযোগিতায় এই হাসপাতাল বেহাল অবস্থা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে।
সৌরভ সাঁতরা, জগদ্দল, উত্তর ২৪ পরগনা
নারীর ভূমিকা
শম্পা ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ ‘যে মেয়েদের মনে রাখিনি’ (১৪-৮) প্রসঙ্গে এই চিঠি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মেয়েদের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে প্রবন্ধকার বলেছেন, বিভিন্ন স্তরে জাতীয়তাবোধ যখন নানা চেহারা পেতে লাগল, সে সময়ে “বিয়ের আগে মেয়েরা পরিবারের কারণে হয়তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী, বিয়ের পরে নয়।” এই রকম একটা সিদ্ধান্তে প্রবন্ধকার কী ভাবে পৌঁছলেন? বিয়ের আগে পরিবারের কারণে উৎসাহী মানে দাঁড়ায়— মেয়েরা কেবলমাত্র পরিবারের পুরুষ সদস্যদের স্বদেশিয়ানায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক কাজে যোগ দিচ্ছিলেন। অথচ, পরাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে অধীনতার গ্লানি অনুভব করে মেয়েদের মনে দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক সচেতনতা জাগা এবং স্বনির্ধারিত ভাবে দেশের কাজে যোগ দেওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আমরা বিশ শতকের গোড়া থেকে মেয়েদের আত্মকথায়, সাহিত্যে, ইতিহাসে পাই। তাঁদের স্বদেশ-চেতনার নানা পরত ছিল।
আর বিয়ের আগে তাঁরা উৎসাহী, পরে নয়— এ কথাই বা কিসের ভিত্তিতে বলা হয়েছে? তাঁরা উৎসাহী ছিলেন না, না কি তাঁদের পায়ে বেড়ি পড়ানো ছিল? তা সত্ত্বেও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন ধারায় বহু মেয়ে কোলের শিশু-সহ কারাবরণ করেছেন, অনেক সময় স্ত্রী-স্বামী এক সঙ্গে দেশসেবা করেছেন, আবার অনেক ক্ষেত্রে বিবাহিত নারী স্বামী-শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধতার সঙ্গে যুঝে গোপনে যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়ে দেশের কাজে যুক্ত থেকেছেন। শেষোক্ত দৃষ্টান্তের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বদনাম’ গল্পের সৌদামিনীকে আমরা স্মরণ করতে পারি।
শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত, কলকাতা-৪৫