ঈশানী দত্ত রায়ের প্রবন্ধ, ‘ঘৃণা, এ বার ত্রিনয়নে’ (২৮-৯) পড়ে আমার মাথায় আটকে পড়া ভাবনাচিন্তাগুলো রাস্তা দেখতে পেল হয়তো। মনে হচ্ছে, আমরা এখন একটা তিন মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রথম রাস্তা উৎসবের দিকে, দ্বিতীয় রাস্তা প্রতিবাদের দিকে আর শেষ রাস্তাটা প্রতিকারের দিকে ধাবমান।
উৎসবে, ছোট-বড় পুজোগুলো সেজে উঠছে, আগের বছরগুলোতে যেমন হত। টিভি খুললেই গৃহস্থর পুজো-বাজেটের দিকে মডেলদের হাতছানি, আগের বছরগুলোতে যেমন হত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠের ভোরের পর উৎসব আর উৎসব। তবে এ বার পুজো প্যান্ডেল প্রতীকী শিরদাঁড়া দিয়ে সাজানো হবে কি না, সেটা সময়ই বলবে। শোনা গেল, জেলার পুজো উদ্বোধনের তালিকা সরকারি ভাবে তৈরি হচ্ছে। তবে, ত্রিনয়ন থেকে ঠিকরে পড়া ঘৃণা ইভিএম পর্যন্ত পৌঁছবে কি না, তার উত্তর বোধ হয় প্রতিবাদের রাস্তার শেষেই পাওয়া যাবে।
প্রতিকারের রাস্তায় আবার কয়েকটা মোড় আছে। প্রথম মোড়ে, ‘আদালত চলছে’। কুরুক্ষেত্রে কৌরব পাণ্ডবদের বাঘা বাঘা সেনাপতিরা যুক্তির তরোয়াল ঘোরাচ্ছেন।
দ্বিতীয় মোড়ে, ‘এজেন্সি খুঁজছে’। পাত্রাধারে তৈল না তৈলাধারে পাত্র? জবাবের অপেক্ষায় অভয়ার পরিবার, সারা বাংলা, সারা দেশ অপেক্ষারত। প্রতিকারের শেষ মোড়ে দাঁড়িয়ে সেই সব ছেলেমেয়ে, যারা রাত দখল করতে গিয়ে আমাদের ২৪ ঘণ্টা দখল করে নিয়েছে। যারা শাসকের (বিরোধীদেরও) আর মোসাহেবদের অহঙ্কার, কপটতা, অসাধুতা, আর দুর্নীতিকে নতজানু করিয়েছে, ৪২ দিন ধরে।
এক শয্যাশায়ী বৃদ্ধা জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনের ছবি টিভিতে দেখতে দেখতে আপন মনেই বলে উঠেছিলেন, “বিধান রায়ের পর, আগামী দিনে বোধ হয় আমাদের রাজ্যে আবার এক জন ডাক্তার অভিভাবক পেতে চলেছি।”
ত্রিনয়নী, উৎসবের প্রাক্কালে আমাদেরও একই প্রার্থনা।
মল্লিনাথ, হাওড়া
দুর্নীতির বিনাশ
‘ঘৃণা, এ বার ত্রিনয়নে’ প্রবন্ধটি সম্পর্কে এই চিঠির অবতারণা। আর জি কর হাসপাতালের বিষয়টি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। সুতরাং, তদন্ত সংক্রান্ত মতামত দেওয়ার অধিকার সীমিত। তবে আন্দোলনের ব্যাপ্তি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার ঘুণ ধরা প্রশাসনিক পরিকাঠামোর সংস্কারে রাজ্য সরকার সদর্থক মনোভাব প্রকাশ করলেও দীর্ঘ দিনের দুর্নীতির দুষ্টচক্রের বিনাশ খুব সহজ কাজ নয়। হুমকি-প্রথার প্রভাব স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বহু দিন ধরেই অবিরত চলছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির ডাক্তারবাবুদের, নার্সদের এবং অন্য কর্মচারীদের হেনস্থা ঘটেই চলেছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। আমার মনে হয়, বড় সরকারি হাসপাতালগুলিতে একটি করে কাউন্সেলিং কেন্দ্র থাকা উচিত, যারা চিকিৎসক এবং রোগীর স্বজনদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে।
বাঙালির শারদোৎসব অবশ্যই হবে। তবে সেই উৎসবের আতিশয্য যেন স্বজনহারা পরিবার বা আন্দোলনের অভিমুখকে ব্যথাতুর না করে। আর জি করের সমগ্র বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তিতিবিরক্ত। স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্নীতির খবর তাদের স্তম্ভিত করছে। সুতরাং, এর পর থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে অত্যন্ত সদর্থক ভূমিকা পালন করতে হবে, যে প্রক্রিয়ার খানিকটা অবশ্য ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলনকে যথার্থ গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পূর্ণ প্রতিফলন হয়। আর কিছু আলটপকা মন্তব্য করা থেকে এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে বিরত থাকতে হবে।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১
স্পর্ধার উৎস
আর জি কর ঘটনার আবহে এক বন্ধুর প্রশ্ন: ‘থ্রেট কালচার’ বা হুমকি-প্রথা নিয়ে। তার বিস্ময় এটাও ‘কালচার’! ঈশানী দত্ত রায় তাঁর ‘ঘৃণা, এ বার ত্রিনয়নে’ প্রবন্ধে আবার নিমগ্ন ‘স্পর্ধা’র উৎস সন্ধানে। শাসক ও শাসক দলের ছোট-বড় বা মাঝারি যে স্তরের নেতা নেত্রী হোন না কেন, প্রতিবাদের ভাষা তাঁদের বরদাস্ত হয় না। তাই যে কোনও ঘটনায় প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেই ধৈর্যচ্যুতি দেখা যায়।
রাজ্য রাজনীতির পটপরিবর্তনের পরেই প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে আগের সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের মুখে কুলুপ আঁটার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। আবার, কোনও জেলার পরাক্রমশালী নেতার হুঙ্কারে শোনা গিয়েছে, সাপের মতো মেরে ফেলার নিদানও। প্রতিবাদের স্বর মৃদু হলেও তা যেন কোনও ভাবে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। বড় ভয়ানক এ ব্যাধি। কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন এক বার দখল করে ফেলতে পারলেই নির্বাচনের আর প্রয়োজন কিসের। একই নীতির প্রয়োগ স্কুলগুলির পরিচালকমণ্ডলীর নির্বাচনেও। রাজ্যের ত্রিস্তরবিশিষ্ট পঞ্চায়েত ও পুরসভার দখল নেওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র। এক বার প্রতিষ্ঠানগুলো শাসকের করায়ত্ত হয়ে যাওয়ার পরে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনে গড়িমসি ও বিরোধী সদস্যদের নিজেদের দলে এনে দলীয় পতাকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া তো রোজকার সংবাদ। বলতে দ্বিধা নেই, এই কাজে যোগ্য সঙ্গত পাওয়া গেছে প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছ থেকেও। সমাজে বা পাড়ায় পাড়ায় ভাল, কৃতী ছাত্র হিসাবে সমীহ আদায় করা আইএএস, আইপিএস বা ডাব্লিউবিসিএস চাকুরে যাঁরা, তাঁরা অধিকাংশ ‘এ বার নীরব করে দাও’ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ওঠাই সমীচীন বলে মেনে নিয়েছেন।
সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত যাঁরা এমনতর ঘটনার সাক্ষীসাবুদ ও প্রমাণ লোপাট করে সমাজে দিব্য তম্বি করার সাহস পায়, তাঁদের সাহস আমরাই জোগাইনি কি? চড়াম চড়াম ঢাকের আওয়াজ, গুড় বাতাসা দেওয়া বা উন্নয়নের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা— সবই তো এত কাল সয়ে এসেছি আমরা। আমাদেরই রাজ্যের এক কন্যার এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরেও আমরা, পাড়ার পুজোকর্তারা হাত বাড়িয়ে রেখেছি সরকারি অনুদানের আশায়।
বরুণ কর, ব্যান্ডেল, হুগলি
অসুর নিধন
ঈশানী দত্ত রায়ের লেখা প্রবন্ধটি হৃদয় স্পর্শ করে গেল। মধ্যবিত্ত ঘরের বাবা-মা অতি কষ্টে একমাত্র মেয়েকে ডাক্তার বানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। তাঁদের সমব্যথী হতেই বাংলার আট থেকে আশি— সর্বস্তরের নরনারী রাজপথে দাঁড়িয়ে মোমবাতি হাতে নিয়ে অশ্রু বিসর্জন করেছেন। তাই প্রবন্ধকারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একটি কথাই বলতে হয়, কেন আজ একটা মেয়েকে এই ভাবে অকালে চলে যেতে হল? এর জন্য দায়ী বর্তমান এই সমাজব্যবস্থা, আর দায়ী শাসকশ্রেণির অহঙ্কার, স্পর্ধা। লোভী দৈত্যের মতো শাসকশ্রেণির মদতে পুষ্ট কিছু মানুষ ছুটে চলেছে অর্থের পিছনে। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে যে কোনও অপরাধকে তারা সংগঠিত করতে দ্বিধাবোধ করছে না।
কিন্তু এ কথা জানা দরকার— চিরদিন কারও সমান যায় না। মজবুত সংগঠন থাকা সত্ত্বেও ৩৪ বছরের বাম শাসনের এক সময় অবসান ঘটেছে। গণতন্ত্রের রাজনীতিতে মানুষই শেষ কথা বলে। আজ যে ভাবে মানুষ রাত দখল, দিন দখল, ভোর দখল করে তিলোত্তমার খুনের বিচার চাইতে রাজপথে নেমেছে, উৎসবে পুরোপুরি ফেরা তাদের পক্ষে আর কোনও ভাবে সম্ভব নয়। পুজোর মণ্ডপে এ বার দেবী থাকবেন না, দেবী নেমে আসবেন রাজপথে। অসুর নিধন করতে। গ্রামবাংলার এক শিল্পী সংবাদপত্রকে বলেছেন— মূর্তি গড়ছি আর হাত কাঁপছে, কী মুখ গড়ব? মেয়েটার কথা মনে হচ্ছে।
যদি মেয়েটির কথা মনে পড়ে, তবে প্রতিবাদ করুন। পথে নামুন, পথে থাকুন। এই পথেই তিলোত্তমার খুনিদের খুঁজে পাওয়া যাবে।
স্বপন আদিত্য কুমার বিশ্বাস, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা