ধনতন্ত্র।
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সব হাতই এক রকম কালো’ (২৬-৯) শীর্ষক প্রবন্ধটি এক নির্মম সত্যের বলিষ্ঠ ও সঠিক প্রকাশ। বর্তমান ও অতীতের ক্ষমতা আস্বাদন করেছে যে রাজনৈতিক দলগুলো, সেগুলো এখন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ফ্যাসিস্ট হয়ে গিয়েছে। গণতন্ত্রের প্রশস্তি করতে করতে এমন বৈশিষ্ট্য আয়ত্ত করেছে এই দলগুলো। সামন্ততান্ত্রিক কূপমণ্ডূকতার নিশ্ছিদ্র আবেষ্টনী থেকে মুক্তির পথ প্রশস্ত করেছিলেন পাশ্চাত্য নবজাগরণের মহান মনীষীবৃন্দ। ব্যক্তির সার্বিক মুক্তির সন্ধান দিয়েছিলেন মানবতাবাদী চেতনার উন্মেষের মধ্যে। জনগণের অধিকার কায়েম হওয়ার পথ বেয়ে গণতন্ত্রের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ধনতন্ত্র তথা পুঁজিবাদ। এই ঐতিহাসিক সত্যটুকু অস্বীকার করা যায় না। তেমনই অস্বীকার করা যায় না এই ব্যবস্থার চেয়ে আরও উন্নততর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও আমরা দেখেছি, যা দেখে রবীন্দ্রনাথের তীর্থদর্শনের অনুভূতি হয়েছিল। তার আপাত পতন এবং তথাকথিত ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের মাধ্যমে বিশ্বায়নের উত্থান হয়েছিল। আজ তার মুখ থুবড়ে পড়েছে, ফ্যাসিবাদী প্রবণতার নখদন্ত প্রকট হয়েছে। সেটাই বিড়ম্বনার কারণ, তা লেখায় সুন্দর ভাবে এসেছে। কিন্তু পুঁজিবাদের অগ্রগতির ধারায় পুঁজিপতিদের মধ্যেকার বাজার দখল সংক্রান্ত তীব্র দ্বন্দ্ব যে কর্পোরেট রাজত্বের জন্ম দিয়েছে, তার ব্যাখ্যা আশা করেছিলাম। কর্পোরেট দুনিয়ার মালিকরা তাঁদের চেতনার রঙে পছন্দের দলগুলোকে রঞ্জিত করবেন, এই সত্য রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ব্যক্তিমাত্রেই ধরতে পারেন। নবজাগরণের ভাবধারায় উদ্দীপিত পুঁজি মালিকদের উত্তরসূরিরা আজ কর্পোরেট সংস্থার কর্তা। তাঁদের আধিপত্য বজায় রাখতে পুঁজি কেন্দ্রীভূত করার সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে জনগণের চিন্তা গুলিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বিজ্ঞানের সঙ্গে আধ্যাত্মিক ভাবনার মিশ্রণ ঘটাচ্ছে এই সব সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট দল। এই সত্য বিশ্লেষণে পাব, সে আশায় ছিলাম।
তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা
রক্তের স্বাদ
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় দেশ জুড়ে ফ্যাসিবাদের শাসনের কথা বলতে গিয়ে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার এবং আমাদের রাজ্য সরকারকেই তুলনায় নিয়ে এসেছেন। সুতরাং তাঁর বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, বর্তমানে কেন্দ্র এবং পশ্চিমবঙ্গ ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রায় একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে। ইতিহাসের আতশকাচের নীচে কেন্দ্র ও রাজ্যের বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এঁদের ফ্যাসিবাদী কায়দা ছাপিয়ে গেছে পূর্বতন সমস্ত শাসনকেই। তবে দেশের আরও কয়েকটি রাজ্যও একই দোষে দুষ্ট, এটাও আজ আর কারও অজানা নয়। তত্ত্বের কচকচানিতে না গিয়ে অতি সরল ব্যাখ্যায় বলা যেতে পারে, যে কোনও জনপ্রতিনিধি, তিনি স্থানীয় কাউন্সিলারই হন, কিংবা মন্ত্রী, প্রত্যেকেই দায়বদ্ধ জনগণের কাছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এটা যেমন অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধি মনে রাখেন না, তেমন আমরা সাধারণ মানুষও অনেক ক্ষেত্রেই ভুলে যাই সেই কথা। আমরা এই প্রতিনিধিদের কাছ থেকে যখন কিছু সুবিধা আদায় করি তখন ভাবি, তিনি যখন জনগণের জন্যেই কাজ করছেন, একটু-আধটু দুর্নীতি করলে সে আর কী এমন দোষের? তখন তাঁর অনেক দোষ-ত্রুটি চলে যায় অন্তরালে। কখনও আবার চেষ্টা করি অন্য মানুষকে এড়িয়ে কী ভাবে নিজের কাজ হাসিল করে নেওয়া যায় তাঁর মাধ্যমে। কোনও মানুষের প্রতি অবিচার হচ্ছে দেখেও না দেখার ভান করে থাকি। কিংবা হয়তো সেই আক্রান্ত মানুষটিকেই ‘দোষী’ বলে দাগিয়ে দিই নেতা বলেছেন বলেই। এই মনোভাবই আসলে রক্তের স্বাদ দেয় এই লোভী জনপ্রতিনিধিদের। এঁরাই যখন আবার যখন তাঁদের ‘মহান কীর্তি’র জন্য জেলে থাকেন, তখন আমরা আলোচনায় ব্যস্ত থাকি, এঁরা কী খেলেন, কী পরলেন, কত ওজন কমল, কোন শীর্ষ নেতার নাম বললেন, এই সব নিয়ে। আবার কখনও বা সংশ্লিষ্ট দলের নেতারাও এঁদের বীর সৈনিকের মর্যাদা দেন।
দল পরিবর্তন করে অন্য দলে গেলে এঁদের পুরনো অনৈতিক কীর্তিকলাপ অগোচরে চলে যায়। সাধারণ মানুষের উপেক্ষাই এঁদের একমাত্র শাস্তি। সুতরাং আমরা যদি এঁদের চিহ্নিত করে নিজেদের ব্যক্তিসত্তা বিসর্জন না দিই, তবে দেখা যাবে সব হাতই কিন্তু বিকেলে ভোরের ফুল ছবিতে কথিত গরিলার মতো রোমশ, তীক্ষ্ণ নখওয়ালা কালো হাত নয়। এটা সৃষ্ট হয় শুধুমাত্র আমাদের সঠিক মানুষকে খুঁজে নেওয়ার ভুলেই।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
আবার যাত্রা
গ্রামের পুজো প্যান্ডেলে এক সময়ে আবশ্যক বিনোদন ছিল যাত্রাপালা। পুরনো বাংলা সাহিত্যের আনাচেকানাচে খুঁজে পাওয়া যাবে যাত্রাপালার আসরের সরস গল্প। যাত্রাভিনয়ের পাত্রপাত্রীরা ছিলেন সেই গ্রামেরই বাসিন্দা। অর্থাৎ, শখের যাত্রাদল। পুজোর অন্তত তিন মাস আগে থেকে শুরু হয়ে যেত মহড়া। মহড়া শুরু হলেই গ্রামে পুজোর আমেজ চলে আসত। সারা দিন যে যার মতো কাজ করার পর সন্ধেবেলায় মিলিত হতেন গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ বা দুর্গামণ্ডপে। লণ্ঠনের তেল শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলত রিহার্সাল। ছেলেরাই দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে মেয়ে সেজে অভিনয় করতেন। যাত্রার সেই দশা এখন অবশ্য নেই। চাকচিক্য এসেছে পোশাকে এবং মহিলা চরিত্রের অভিনয়ে। কিন্তু অতিমারির সময়ে যাত্রাশিল্পের উপর প্রচুর আঘাত এসেছে। বাণিজ্যিক যাত্রাশিল্পের অবস্থা এমনিতেই ক্রমে খারাপ হচ্ছিল। গত দু’বছর কলকাতার চিৎপুর যাত্রাপাড়া হয়ে গিয়েছিল জনমানবশূন্য। এ বছর অবশ্য নতুন আশায় অপেরা হাউসগুলো কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। যাত্রামোদী মানুষের আহ্বানে এই শিল্প নতুন করে আশার আলো দেখছে।
কিন্তু অনেক গ্রামের পুজো কমিটি শহুরে মেকি সংস্কৃতিকে অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে গ্রামের পুজো প্যান্ডেলের প্রকৃত বিশুদ্ধতার গন্ধ। তারা বহু খরচ করে অনুষ্ঠান করে, কিন্তু যাত্রাশিল্পের প্রতি উদাসীন। আবার কোনও কোনও গ্রাম দারিদ্রের মোকাবিলা করেও যাত্রাপালার আয়োজন করে। তাদের জন্যই একটু হলেও টিকে আছে এই শিল্প। তবে যাত্রাশিল্পীরা আশাবাদী। আগামী দিনে তাঁদের কদর অবশ্যই বাড়বে।
শঙ্খ অধিকারী, সাবড়াকোন, বাঁকুড়া
উচিত শিক্ষা
‘বেআইনি নিয়োগ ৮১৬৩!’ (২৯-৯) প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে বলতে চাই, এত দিন ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ধীর গতি দেখা যেত। কিন্তু স্কুলে নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ম বহির্ভূত ভাবে নিযুক্ত শিক্ষকদের পদত্যাগের সময় বেঁধে দিলেন। এই সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন। এর ফলে যেমন চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে চাকরি না পাওয়ার হতাশা কাটবে, তেমনই বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। পশ্চিমবঙ্গে সঠিক যোগ্যতা দিয়ে যে চাকরি পাওয়া যায়, সেটাই ভুলতে বসেছিল মানুষ। এই রায়ের ফলে কিছুটা হলেও এই ধারণা দূর হবে। যারা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে, তাদের উপযুক্ত শিক্ষা হবে। বেআইনি ভাবে কিছু করার আগে মানুষকে ভাবতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হলে মানুষকেও অপরাধী এবং অপরাধে সাহায্যকারী, উভয়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।
দিগন্ত চক্রবর্তী, জাঙ্গিপাড়া, হুগলি