Karnataka Assembly Election 2023

সম্পাদক সমীপেষু: দুর্নীতিকে প্রত্যাখ্যান

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণের মতো মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলি বিজেপি শাসনে গুরুত্ব পায়নি, বরং এ সবের তীব্রতা বেড়েছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২৩ ০৬:৫৬
Share:

কর্নাটকের মানুষ ধর্মের নামে বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। — ফাইল চিত্র।

বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি পুরোপুরি ব্যর্থ হল কর্নাটকে। কর্নাটকে জাত ও ধর্মের নামে বিভাজনকে পুঁজি করেই ভোট করতে ঝাঁপিয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ বিজেপির সব শীর্ষ নেতা। কিন্তু মানুষ বিভাজনের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যানই করেছেন।

Advertisement

বাস্তবে কর্নাটকের বিজেপি সরকার আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ডুবেছিল। এই দুর্নীতি জনগণের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সেই কারণেই বিজেপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ধর্মের জিগিরকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছে। অন্য দিকে, দুর্নীতির অভিযোগ থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে ধর্মীয় মেরুকরণের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের সরকারি প্রকল্পে ৪০ শতাংশ কাটমানি খাওয়ার অভিযোগ খণ্ডন করতে পারেনি তারা। ধর্ম এবং জাত নিয়ে রাজনীতি করতে রাজ্যের ৪ শতাংশ ওবিসি মুসলিমদের সংরক্ষণ বাতিল করে তা ভোক্কালিগা এবং লিঙ্গায়েতদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিল বিজেপি। আবার মুসলিম বিদ্বেষের রাজনীতি করতে ইতিহাস থেকে টিপু সুলতানের মতো চরিত্রকেও টেনে নিয়ে এসেছিল। ভোটের ফলে স্পষ্ট, বিজেপির এই জাত কিংবা ধর্মের রাজনীতির কোনওটাই কাজ দেয়নি। বিজেপির তৈরি জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে কর্নাটকের শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা কার্যত এককাট্টা হয়েছিলেন।

মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ও স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণের মতো মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলি বিজেপি শাসনে গুরুত্ব পায়নি, বরং এ সবের তীব্রতা বেড়েছিল। পাশাপাশি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার লাগাতার একচেটিয়া পুঁজির হয়ে কৃষক ও শ্রমিক বিরোধী নীতি চালিয়ে গেছে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রীকেই বিজেপি কর্নাটকে তাদের নির্বাচনী মুখ করে প্রচার চালিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও বার বার তাঁর উপরই আস্থা ও ভরসা রাখার জন্য রাজ্যের মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। নির্বাচনী ফলে প্রমাণ, মানুষ তাঁকেও প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই কর্নাটকে বিজেপির পরাজয় শুধু তাদের রাজ্য নেতৃত্বের নয়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তথা প্রধানমন্ত্রীরও পরাজয়।

Advertisement

সমরেন্দ্র প্রতিহার, কলকাতা-

অগ্নিপরীক্ষা

সম্প্রতি কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দলের নিরঙ্কুশ জয় শুধু যে ওই দলটিকে রাজনৈতিক ভাবে পুনরুজ্জীবিত করল তা-ই নয়, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কতকগুলি প্রশ্নের বা আশার জন্ম দিল।

প্রথমত, গত বছরের শেষের দিকে হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে এবং সদ্য অনুষ্ঠিত কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে বিশাল জয় কংগ্রেসকে পুনরায় প্রধান বিজেপি-বিরোধী শক্তি হিসাবে মান্যতা পাওয়ার বিষয়ে কয়েক কদম এগিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই রাজস্থান, ছত্তীসগঢ় এবং মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। ওই তিন রাজ্যে যদি কংগ্রেস জয়ের ধারা বজায় রাখতে পারে, তবে প্রশ্নাতীত ভাবে কংগ্রেস তথাকথিত বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে, যারা কংগ্রেসকে বিরোধী জোটের নেতৃত্বের ভার দিতে অনিচ্ছুক, বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করবে।

দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী-সহ বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের দ্বারা ধর্মীয় মেরুকরণ এবং বিভাজনের শত চেষ্টা সত্ত্বেও কর্নাটকবাসী ওই ফাঁদে পা না দিয়ে হিন্দুত্ববাদকে প্রায় বর্জন‌ই করেছেন ভোটের মাধ্যমে।

তৃতীয়ত, এই নির্বাচনে কর্নাটকের আঞ্চলিক দল জেডি(এস)-এর শোচনীয় পরাজয় নির্দেশ করছে যে, কর্নাটকবাসী আর আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি সম্বন্ধে উৎসাহিত নন। এটি এক দিক দিয়ে শুভ লক্ষণ। কারণ, ইদানীং আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে এক প্রকার সুযোগসন্ধানী মানসিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, যেটা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অনুকূল নয়। উপরন্তু, এই নির্বাচনের অন্যতম দিক হল দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের রায়। নানা ভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বোম্মাই সরকারের পতন প্রায় অবশ্যম্ভাবী ছিল। এটিও গণতান্ত্রিক ভারতের পক্ষে শুভ লক্ষণ।

চতুর্থত, এই নির্বাচন কংগ্রেস দলের নেতা রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনে হয়তো এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাস্তবিকই, রোদ, ঝড় আর বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে কন্যাকুমারী থেকে উত্তরে শ্রীনগর পর্যন্ত ‘ভারত জোড়ো’ পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেওয়া তাঁকে এক বিরাট স্থানে উন্নীত করেছে। তাঁর এই যাত্রাপথে কর্নাটক রাজ্যের যে ২০টি বিধানসভা কেন্দ্র তিনি স্পর্শ করেছিলেন, তার মধ্যে ১৫টি কেন্দ্রেই এ বার কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। তবে এখনও অনেক কাজ বাকি। ৭১টি এমন আসন আছে, যেখানে কংগ্রেস তার দলীয় সংগঠন এবং অন্যান্য ভোট সম্পর্কিত বিষয়কে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারলে ওই আসনগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি আসন নিজেদের দখলে আনতে পারবে। এইখানেই নেতা হিসাবে রাহুল গান্ধীর অগ্নিপরীক্ষা!

অমিতকুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫

শুভ সূচনা

বিজেপির হাতে ছিল রাজ্যের শাসন। বিধানসভা ভোটে সেই রাজ্য ধরে রাখতে চেষ্টার কোনও কসুর করেনি বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের মতো তারকা প্রচারক মাঠে নেমে একের পর এক সভা করেছেন। তবুও শেষ পর্যন্ত ভোটের ময়দানে কংগ্রেসের কাছে হারতেই হল পদ্ম শিবিরকে।

মাস দুয়েক আগে এক ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রাক্-লোকসভা নির্বাচন সমীক্ষায় বলা হয় যে, আপাতদৃষ্টিতে অপরাজেয় বিজেপির বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিকল্পের প্রশ্নে কংগ্রেস সমর্থকরা পুরোপুরি নিশ্চিত নন যে, তাঁদের দল একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, ভারত জোড়ো যাত্রা ছবিটি খুব বেশি পরিবর্তন করেছে বলে মনে হয় না। সমীক্ষায় বলা হয়, ২২ শতাংশ মানুষ কংগ্রেসের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কংগ্রেসকে সমর্থন করা দশ জনের মধ্যে চার জন তাঁদের দলকে একটি কার্যকর বিকল্প বলে মনে করেছেন। এই সমীক্ষায় একটি বড় অংশ কংগ্রেসের উদ্দেশ্য, এর নেতৃত্ব এবং ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অ-নেহরু-গান্ধী (মল্লিকার্জুন খড়্গে)-কে সভাপতি নির্বাচিত করা সত্ত্বেও, ৫৩ শতাংশ মানুষ দলটিকে রাজবংশীয় ঐতিহ্যের বাহক বলে মনে করেন। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ৫১ শতাংশ মানুষ মনে করেন রাহুল গান্ধী দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

কিন্তু কর্নাটকে কংগ্রেস যে ধরনের জয় পেয়েছে, তা বিরোধী দলের রাজনীতির জন্যও অনেক অর্থবহ। হিমাচল প্রদেশের বিজয় কংগ্রেসের ক্ষয়িষ্ণু মনোবলকে কিছুটা সমর্থন করেছিল, কিন্তু এতে এমন একটি বার্তা পাওয়া কঠিন ছিল, যা সমগ্র বিরোধীদের সংহতিকে প্রভাবিত করবে। কর্নাটকের ক্ষেত্রে সে রকম নয়। এটি কংগ্রেসের জন্য শুধুমাত্র যে নির্বাচনী ফলাফলের সঙ্গে রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার ইতিবাচক প্রভাবকে যুক্ত করার সুযোগ দিয়েছে তা নয়, সেই সঙ্গে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করার বিজেপির প্রচেষ্টাকেও ব্যর্থ করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই, এই দু’টি বিষয়ই আগামী দিনে বিরোধী দলের ভাবমূর্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাহুল গান্ধী সম্পর্কে বলা হয়েছে, নির্বাচনী লড়াইয়ে তাঁর প্রচেষ্টায় দল খুব একটা সুবিধা পায় না। ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা নিয়েও একই কথা বলা হচ্ছিল যে, যাত্রার জন্য জনগণের সমর্থন পাওয়া এক জিনিস আর এই সমর্থনকে ভোটে রূপান্তরিত করা একেবারেই অন্য কথা। কর্নাটকে ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা যে অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেখানে কংগ্রেসের ভাল ফল এই ধারণা পরিবর্তন করতে সাহায্য করতে পারে।

দলীয় নেতৃত্ব প্রথম বৈঠকেই সিদ্দারামাইয়ার নাম নিয়ে একমত হয়ে শুরুটা ভাল করেছেন। তবে সামনের রাস্তাটি কম বিপজ্জনক নয়। সেই পথ কংগ্রেস কী ভাবে অতিক্রম করে, সেটাই এখন দেখার।

অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement