বাঙালির অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল যুদ্ধ করার। বাঙালি সমরভীরু নয়, সামরিক যোগ্যতায় মার্শাল রেস-এর সমকক্ষ— এটা প্রমাণ করা ছিল তার জাতিগত তাগিদ। সেই সুযোগ এল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) সময়। একদল আগ্রহী ও শিক্ষিত বাঙালি কাজে নেমে পড়লেন। রাজভক্তি দেখানোর তাগিদের পাশাপাশি বাঙালির সমর-দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ সামনে এল। বাঙালি পল্টন গঠনের জন্য সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে একটি বেসরকারি কমিটিও গঠন করা হল— ‘বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কমিটি’। এর সভাপতি হলেন বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ এবং সেক্রেটারি ডা. শরৎ কুমার মল্লিক। সঙ্গে রইলেন স্যর রাসবিহারী ঘোষ, প্রিন্স ভিক্টর নারায়ণ, রাজা পিয়ারিমোহন মুখোপাধ্যায়, মহারাজা মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর— কে নয়! রাজার জন্য যুদ্ধ করতে বাঙালি এতই উদ্গ্রীব ছিল যে তারা এর যাবতীয় আর্থিক দায় বহনেও রাজি ছিল। কমিটি দরখাস্ত আহ্বান করলে আবেদনের বেশির ভাগই আসে জমিদার, উচ্চশিক্ষিত বা ধনী পরিবারের যুবকদের থেকে। এ ভাবেই ইংরেজদের প্রয়োজনে গঠিত হয় '49 Bengal Regiment'. একে ডবল কোম্পানিও বলা হত।
বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কমিটি বাঙালি পল্টন গঠনকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে সচেষ্ট হয়। কলকাতা এবং প্রতিটি জেলার সদর ও ছোট শহরে সৈনিক ভর্তির জন্য নানা কমিটি গড়ে ওঠে। এই সব কমিটি সেনা সংগ্রহের জন্য অসংখ্য সভা করে, কলকাতা থেকে জাতীয় নেতারা আসেন যুবকদের উৎসাহ দিতে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, ‘‘আমি শহর থেকে শহর ঘুরে বেড়িয়েছি আমার দেশের সম্পন্ন শ্রেণীকে উদ্দীপ্ত করার জন্য যাতে তারা সৈনিক হয়ে বিপদগ্রস্ত সম্রাটের জন্য যুদ্ধ করে।’’ সরলা দেবী চৌধুরানী শিক্ষিত বাঙালি যুবকদের, ইউনিভার্সিটির মেডেলের জন্য লালায়িত না হয়ে ‘‘ভিক্টোরিয়া ক্রস নিতে তোমাদের সাধ হয় না?’’ বলে উদ্ধুদ্ধ করেন। সরকার ডাক দিয়েছে পৌরুষহীনতার খোলস ছাড়তে, কলম ছেড়ে বন্দুক দিতে প্রস্তুত ইংরেজ সরকার। সরলা দেবী লেখেন, ‘‘লও সেই ভূষণ, পুরুষালী সাজে সাজ, আমরা তোমাদের মায়েরা বোনেরা তোমাদের দেখে চক্ষু জুড়াই।’’ ‘কায়স্থ’ পত্রিকায় লেখা হয়, ‘‘বাঙ্গালী জাতির উপর থেকে মেকলে অঙ্কিত কলঙ্ক কালিমা মুছিয়া ফেল, মেকলের জাতিকে দেখাও— বাঙ্গালী কি না করিতে পারে।’’ অন্যান্য নেতা এবং পত্রপত্রিকা একই ধরনের বক্তব্য, বিবৃতি ও রচনা প্রকাশ করে।
সৈনিক ভর্তির জন্য এত আবেদন সত্ত্বেও, বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটল না। সারা বাংলা থেকে অনেক আবেদন জমা পড়লেও, বাস্তবে রিক্রুট হতে এলেন সামান্য কয়েক জন। ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১১০ জন। ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকা ক্ষোভের সঙ্গে জানায়, পত্রিকা আর সভায় যত উত্তেজনাই সৃষ্টি করা হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে, এক সপ্তাহের মধ্যে জনাকীর্ণ দু’টি জনসভা থেকে এক জনও বাঙালি পল্টনে ভর্তির জন্য এগিয়ে আসেনি। ‘বেঙ্গলি’ পত্রিকাও ক্ষোভ জানিয়ে লেখে, রায়বাহাদুর নয়, কেবলমাত্র সিপাই বলেই এই যুদ্ধ-বিমুখতা! সৈনিক মোসাহেব নয়, যত বেশি বিপদ তত বেশি ত্যাগ, আর ততটাই যোগ্যতার কাজ। ‘‘আমাদের জনপ্রিয় নেতারা তাঁদের সন্তান, পৌত্র বা নিদেন পক্ষে জামাইদের রাজকীয় সেনাবাহিনীর পোষাক পরিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করছেন না কেন’’ বলে মন্তব্য করে ‘দি ইংলিশম্যান’ পত্রিকা।
সেনাবাহিনীতে যাঁরা যোগ দিলেন, তাঁরা মূলত এসেছিলেন রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা, উচ্ছ্বাস ও তারুণ্যের রোমান্টিকতায়। যুদ্ধের ময়দানে এ মোহ কেটে যায়। আর যুদ্ধে বাঙালি পল্টনকে অংশ নিতেই হয়নি, বা অংশ নিতে দেওয়ার যোগ্য বিবেচনা করাই হয়নি।
মেসোপোটেমিয়ায় এঁরা কেবল সেনাশিবির দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। আর সেখানে নিজেদের মধ্যে কলহ, পরিণামে দুই বাঙালি অফিসার হত্যা, শারীরিক সক্ষমতায় অযোগ্য বিবেচিত হওয়া, রোগব্যাধি, ইংরেজ অফিসারদের ব্যঙ্গবিদ্রুপের মধ্যেই বাঙালি পল্টনের কাহিনি শেষ হয়।
প্রলয় চক্রবর্তী
বারাসত
মৌলবি চক্রবর্তী
দিনটি ছিল ১৯৪৭-এর ১৪ অগস্ট। করাচি গণপরিষদে ক্ষমতা হস্তান্তরের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ফিরছিলেন, পরের দিন দিল্লিতে ওই একই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে। পথে সামসাত্তা স্টেশনে গাড়ি থেমে গেল লাহৌরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হওয়ার খবর পেয়ে। প্রায় সাত ঘণ্টা স্টেশনে বসে থেকে ভাগ্যক্রমে একটি ট্রেন পেয়ে গেলেন। পরের দিন সংবাদপত্রে দেখলেন, আর এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলে এ জীবনে আর স্বাধীন ভারত দেখা হত না। সে দিন ওঁদের ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পরে এক নরমেধ যজ্ঞে ওখানকার সব হিন্দুকে হত্যা করা হয়। সে দিনের সেই যাত্রীটি ছিলেন আমাদের বঙ্গবাসী কলেজের প্রয়াত অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তী।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ওঁর রাজনৈতিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে থাকলেও, উনি নিজেকে কখনও কেবল হিন্দু বলে মনে করতেন না, কাউকে চিহ্নিত করতেন না কেবল মুসলমান বলে। দাঙ্গার হিংস্র চেহারা উনি এর আগেই গাঁধীজির সঙ্গে নোয়াখালির পথে ঘুরে স্বচক্ষে দেখেছিলেন। কোনও কিছুই তাঁকে মুসলমানবিরোধী করতে পারেনি। দাঙ্গাবিক্ষুব্ধ পথে গাঁধীজি তাঁকে বলেছিলেন— ‘‘মাই বয়, হোয়েনএভার অ্যান্ড হোয়ারএভার দিস ডেভিল অব কমিউনালিজ়ম রেজ়েস ইটস হেড, ফাইট ইট উইথ অল ইয়োর ফোর্স।’’ এই নির্দেশ তিনি সারা জীবন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গিয়েছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি এবং বাংলা ভাষার অপমানের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলনের ভগীরথ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে করাচি গণপরিষদে তিনি যুক্তিতর্কের তুফান তুলেছিলেন। আজকের যোগীবাবুরা কল্পনাও করতে পারবেন না, এক ব্রাহ্মণ আর এক কায়স্থ কী ভাবে যোগীবাবুদের তিরবিদ্ধ মুসলমানের বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদা এবং মাতৃভাষার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
করাচি গণপরিষদে মহম্মদ আলি জিন্নার সামনে আমাদের অধ্যাপকের শাণিত বাগ্মিতা দেখে সে দিন ‘ডন’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল— "Prof. Chakrabarty can quote Surah from Holy Quran as quickly as a sloka from the Vedas. He was known as Moulavi Chakrabarty in the Pakistan Parliament."
ধর্মের ধ্বজা দেখিয়ে আজ যারা মানুষকে দেশছাড়া করতে চাইছে, তাদের উদ্দেশে রাজকুমারবাবুর সে সময়ের অমোঘ নির্দেশটি নিবেদন করা দরকার— "Let me tell the House, you cannot make a man a pure Mussalman or a Pure Hindu by outward Legislation. It is a matter of inner purification and inner purity." এর মর্ম অনুধাবন করতে পারলে আজকের নেতারা সহজেই বুঝতে পারতেন, চক্রবর্তী কী করে মৌলবি হয়ে যেতে পারেন, কেমন করে গফুর মিয়াঁ স্বয়ং মহেশকে হত্যা করার পরেও রক্তের দাগ লেগে থাকে তর্করত্নের হাতে।
অরুণকান্তি দত্ত
বেলুড় মঠ, হাওড়া
পরামর্শ
গ্রামের লোককে চিকিৎসার জন্য প্রায়ই শহরে আনতে হয়। এ বিষয়ে দু’টি পরামর্শ। এমন ব্যবস্থা করা জরুরি, রোগীরা যাতে নিজেদের মোবাইলে বা কাছের ব্লক হাসপাতালে গেলে জানতে পারেন, জেলা বা কলকাতার কোন হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিত ভাবে এবং সবচেয়ে দ্রুত পেতে পারেন এবং কোথায় কোথায় বেড খালি আছে। আর, অঞ্চলের ক্লাবগুলোকে একটা করে অ্যাম্বুল্যান্স কিনে দিলে, শুধু মাত্র ড্রাইভারের মাইনে আর তেল-খরচ তারা আংশিক রোগীর ও আংশিক সরকারের সাহায্যে এবং স্থানীয় শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের সহযোগিতায় চালাতে পারে।
কাবেরী সাউ
কলকাতা-৩৪
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।