গাড়ির জানালা খুলে প্লাস্টিকের বোতলটি সবে বাইরে ফেলতে যাচ্ছিলেন এক সহযাত্রী। হাঁ হাঁ করে উঠলেন গাড়ির চালক। ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘‘মনে রাখবেন এটা প্লাস্টিক-বর্জিত রাজ্য। রাস্তার ধারে, জলে জঙ্গলে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, ক্যারি-ব্যাগ এ সব ফেলা নিষেধ।’’ পর ক্ষণেই সতর্কবার্তা: ‘‘যত দিন এ রাজ্যে থাকবেন, কথাটা মনে রাখবেন।’’
এত ক্ষণ পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আসতে আসতে গাড়ির যাত্রীরা জানালা দিয়ে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছিলেন ব্যবহার হওয়া প্লাস্টিকের কাপ, খালি জলের বোতল, চিপসের ফাঁকা প্যাকেট। চালক কিছু বলেননি। কালিম্পং জেলা পুলিশের এলাকা পেরিয়ে রংপো-র ‘ওয়েলকাম টু সিকিম’ লেখা স্বাগত দরজা পেরোতেই চালক অনিল ছেত্রীর অন্য রূপ। বললেন, ‘‘সিকিমে প্লাস্টিক রাস্তায় ফেললেই পাঁচ হাজার টাকা ফাইন। আমার গাড়ি থেকে কেউ কিছু ফেললে আমাকেও জরিমানা দিতে হবে।’’
বলতে চেষ্টা করলাম, আপনাদের রাজ্য খুব ছোট। আপনাদের পক্ষে যেটা সম্ভব, পশ্চিমবঙ্গের মতো বড় রাজ্যে তা সম্ভব নয়। কথা শেষ না হতেই অনিল গলায় কিছুটা শ্লেষ মিশিয়ে বললেন, ‘‘সাব, মহারাষ্ট্র নিশ্চয়ই ছোট রাজ্য নয়। ওরা প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করলে, আপনারা পারবেন না কেন?’’
গ্যাংটকের হোটেলকর্মী পূরণ থাপা বললেন, পশ্চিমবঙ্গের টুরিস্টরাই সঙ্গে করে নিয়ে আসেন প্লাস্টিকের গ্লাস, বোতল, পলিথিনের প্যাকেট। প্রতি দিন সেই প্যাকেট পুরসভার নির্দিষ্ট গাড়িতে ফেলে আসতে হয়। হোটেলে জমিয়ে রাখলেই জরিমানা।
প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার যে শীঘ্রই সিকিম সরকার নিষিদ্ধ করতে চলেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সচিবালয়ে একটি আলোচনায় গিয়ে। দেখা গেল উপস্থিত সকলের সামনে ঢাকা দেওয়া পোর্সিলিনের কাপ। রাজ্যের সচিব পর্যায়ের এক অফিসার ওই আলোচনায় জানালেন, ‘‘স্বচ্ছ সিকিম তৈরির পথে আমরা প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার বন্ধের কথা ভাবছি। কাজটা শুরু হচ্ছে রাজ্যের সচিবালয় থেকে। পরিকল্পনাকারীরা পথ দেখালে মানুষকেও সচেতন করা যায় তাড়াতাড়ি।’’
কথাটা শুনতে শুনতে চোখের সামনে বর্ষায় কলকাতার চেহারাটা ফুটে উঠল। প্লাস্টিক আর থার্মোকলে পুকুরের জল দেখাই যায় না। একটু বৃষ্টি হলেই গালিপিটের মুখে জমে যায় প্লাস্টিক। জল আর নামে না। গঙ্গায় জাল ফেললে উঠে আসে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের পরিত্যক্ত প্যাকেট।
শিলিগুড়ি পুরসভা এক সময় পুর এলাকায় প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। মোটা অঙ্কের জরিমানা আদায় শুরু হতেই কমে যায় প্লাস্টিক ব্যবহার। কিন্তু আবার জরিমানায় ছাড় দিতেই ফের প্লাস্টিক দূষণের কবলে পড়ে সিকিমের প্রতিবেশী শহরটি। দমদম পুরসভার একটি ওয়ার্ডের এক কাউন্সিলার পাড়ার লোককে বুঝিয়ে সেই ওয়ার্ডকে এখনও পর্যন্ত প্লাস্টিক বর্জিত রাখতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু সেই একটি ওয়ার্ডের ওই উদ্যোগ থেকে শিক্ষা নেয়নি কেউ।
প্রতি বর্ষায় কলকাতার বেহাল নিকাশির মূলে যে প্লাস্টিক, তা অজানা নয় কারও। তবু প্লাস্টিক নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে রাজ্য সরকারের টালবাহানা চলছেই। পশ্চিমবঙ্গীয় জঙ্গল, পাহাড়, নদীেত জমা হচ্ছে কেজি কেজি প্লাস্টিক। নদীপথ ধরে তা নেমে আসছে সমতলে, ভেসে চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। মহারাষ্ট্র পারে, সিকিম পারে। আমরা পারি না।
মুম্বইয়ের এক বন্ধুর কাছে শুনছিলাম, যে ভাবে কড়া আইন দিয়ে রাত দশটার পরে শব্দদানবকে বশে এনেছিল মহারাষ্ট্র, প্লাস্টিক বর্জনের ক্ষেত্রেও তারা একই রাস্তা নিয়েছে। শুধু আইন তৈরিই নয়, তা কার্যকর করার দিকেও কড়া নজর রাখা হচ্ছে। প্রতিটি পুরসভার কাউন্সিলার, বা পঞ্চায়েত সদস্যকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে কী করতে হবে। মাথার উপরে থাকছে পুলিশ। মুম্বই শহরে ২৪৯ জনের একটি বাহিনীকে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। বাধা কম আসেনি। বাণিজ্য রাজধানীর শিল্পমহলের একাংশ লাগাতার চাপ সৃষ্টি করে গিয়েছে আইনটি যাতে কার্যকর না হতে পারে। শেষ পর্যন্ত আবেদনকারী শিল্প সংস্থাগুলিকে তিন মাসের ছাড় দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে তাদের প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজে নিতে বলা হয়েছে। তাই বন্ধুর বাবা-মা যখন বেড়াতে যাবেন তাঁর কাছে, মুম্বই-বাসিন্দা বন্ধুটি লিখে পাঠিয়েছেন, পলিথিনের ব্যাগ বা প্লাস্টিক বোতল কিন্তু সঙ্গে আনা যাবে না।
শুধু নিকাশির পথেই বাধা নয় প্লাস্টিক। আরও নানা ভাবে সে পরিবেশ দূষিত করে। পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, প্লাস্টিক হল বায়ো-ননডিগ্রেডেবল, অর্থাৎ মাটির নীচে থাকতে থাকতে তা কখনওই মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। মাটির নীচে যে সব ব্যাক্টিরিয়া রয়েছে, সেগুলি প্লাস্টিক হজম করতে পারে না। এ এক বড় সমস্যা। একটি সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে ফোম-প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করি সেগুলি মাটিতে কিংবা জলে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে আনুমানিক ৫০ বছর সময় নেয়। ওই ৫০ বছর ধরে ফোম-প্লাস্টিক কাপ পরিবেশকে দূষিত করে চলে। আর সমুদ্রের জলে যদি কোথাও প্লাস্টিকের জাল আটকে থাকে তা হলে ৬০০ বছর পর্যন্ত তা অক্ষয় হয়ে থাকে।
প্লাস্টিক যে আপনি পুড়িয়ে ফেলবেন সেই উপায়ও নেই। কারণ, প্লাস্টিক পুড়লে যে সব গ্যাস পরিবেশে মেশে তার সব ক’টিই মানুষের শরীরের পক্ষে হানিকর। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে সমুদ্রে যে সব প্লাস্টিক জমা হয় সেগুলি রোদে, জলে এবং নানা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় বটে, কিন্তু সেই ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার সময়ে প্লাস্টিক থেকে ‘বিসফেনল এ’ নামের এমন একটি পদার্থ নিঃসৃত হয় যা মানুষ, গাছপালা কিংবা অন্য প্রাণীর শরীরে ঢুকলে বিভিন্ন কোষের ক্ষতি করে।
দেশের মধ্যে প্রথম প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করেছিল সিকিম, ১৯৯৮ সালে। তখন যিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সেই পবন কুমার চামলিং এখনও একই চেয়ারে। প্রথমে কড়া আইন করে, জরিমানা আদায় করে চালু হয় প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ অভিযান। টানা ২৩ বছরের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ‘‘এখন আর নজরদারি চালাতে হয় না। রাস্তায় কেউ প্লাস্টিক ফেললে মানুষই বাধা দেন।’’ মনে পড়ল আমাদের গাড়ির চালক নির্মলের কথা।
বিভিন্ন বাড়ি এবং হোটেল থেকে সংগ্রহ করা চিপসের প্যাকেট দিয়ে নানা শিল্পকর্ম তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। মুখ্যমন্ত্রী বলছিলেন, ‘‘আমরা তো ওই সব খাবার রাতারাতি বন্ধ করতে পারি না! তাই কী ভাবে ওই সব প্যাকেট অন্য ভাবে ব্যবহার করা যায় সেই চেষ্টা চালাচ্ছি।’’
আমাদের পশ্চিমবঙ্গ কবে এই ভাবে ভাববে!