Indian Farmers

সম্পাদক সমীপেষু: চাষি ও সরকার

চাষের পরিকাঠামো অনুন্নত, দুর্বল। এমনিতেই চাষি ফি বছর বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে মার খান। বাজারে তাঁর ফসল নিয়ে পৌঁছতেই পারেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০২৪ ০৬:৪২
Share:

‘ধামাচাপার চেষ্টা’ (১৮-৭) সম্পাদকীয়তে কে বা কারা ধামাচাপা দিচ্ছে, তা সে ভাবে স্পষ্ট হয়নি। উৎপাদন ব্যবস্থা সাধারণ ভাবে কৃষি, শিল্প ও পরিষেবায় বিভক্ত। সোজা নিয়মে কিছু সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এক, শিল্প বা পরিষেবা ক্ষেত্রকে সরকার বেশি আদর দিচ্ছে। দুই, কৃষিক্ষেত্রে কিছু বলশালী গোষ্ঠী সরকারি ক্ষীর খেয়ে নিচ্ছে। তিন, ফসলের প্রকৃত উৎপাদক সরকারি সুযোগ-সুবিধার নাগাল পাচ্ছেন না। চার, আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ আছে। ‘ধামাচাপার চেষ্টা’ করছে যারা, প্রথমেই তাদের সংযত করা দরকার ছিল। প্রবন্ধটি সে দিকে না গিয়ে সেখানে প্রথমেই কৃষকের দাবির ন্যায্যতা ও কৃষকের নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

Advertisement

সম্পাদকীয়ের মতে, বর্তমান অবস্থায় কৃষকের আলোচ্য সব দাবি মানলে প্রথমত, কৃষি একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র হয়ে যাবে, যা ভারতে সমগ্র কৃষিব্যবস্থার সঙ্গে অসঙ্গত, দ্বিতীয়ত, চাষির লাভ সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না ও তৃতীয়ত, একটি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ দিয়ে দেশের নীতি নির্ধারণ করা চলে না। শেষে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত? প্রত্যুত্তরে বলতে হয়, ভারতে কৃষিব্যবস্থা যে স্বতন্ত্র তার প্রথম কারণ নিজের জমিতে নিজের শ্রমে তৈরি ফসলে সারা বছর পরিবারের জন্য অন্তত দিনে দু’মুঠো অন্নসংস্থান করতে পারত ভারতের কৃষিসমাজ। আজকের শিল্প, পরিষেবার যে এত রমরমা, তা এই কৃষিসমাজের উদ্বৃত্ত শ্রমের ফসলে তৈরি। আর আজ সেই কৃষকের উত্তরপ্রজন্ম বাকি ভারতবাসীর মুখে অন্নসংস্থান করলেও নিজভূমে পরবাসী, অভুক্ত, অপুষ্ট, অশিক্ষিত। অতিরিক্ত কিছু নয়, সামান্য স্থিতাবস্থার জন্য দাবি, আন্দোলন করলে পুলিশের লাঠি খেতে হয়, মারা যেতে হয়।

চাষের পরিকাঠামো অনুন্নত, দুর্বল। এমনিতেই চাষি ফি বছর বন্যা, খরা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে মার খান। বাজারে তাঁর ফসল নিয়ে পৌঁছতেই পারেন না। মাঠের ফসল মাঠে অতি কম দামে কার্যত লুট হয় ফড়ে, দালাল ইত্যাদি নানা দুষ্টচক্রের মাধ্যমে। সরকারের কোটি চোখ, সরকার সব জানে, দেখে। অন্য ভাবে বলা যায়, এই লুটে তারা রাজনৈতিক মদত দেয়। সরকার ভাল রাস্তা তৈরি করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত। সেচ ব্যবস্থা মন্দের ভাল। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রথমেই নিজে সংযত হয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে কৃষকের আয় বাড়লে তার ক্রয়ক্ষমতা ও অভ্যন্তরীণ বাজার সমৃদ্ধ হয়। এটুকু যদি না পারে তা হলে বলতে হয়, সরকার নিজেই নিজের অপকীর্তি ‘ধামাচাপার চেষ্টা’ করে চলেছে।

Advertisement

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

প্রতিশ্রুতির পরে

‘ধামাচাপার চেষ্টা’ সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমাদের দেশে সরকারি সহায়ক মূল্য সম্পর্কিত (এমএসপি) কোনও আইন নেই। সবটাই সরকারের মর্জি। ইচ্ছে করলে সরকার এমএসপি ঘোষণা করতে পারে, আবার না-ও পারে। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের কৃষকদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তখনই সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় যে, এমএসপি-কে আইনসঙ্গত করা হবে, বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল-২০২০ বাতিলের কথা বিবেচনা করা হবে। আন্দোলনে যে সব কৃষকের উপর মিথ্যে মামলা চাপানো হয়েছিল, তা তুলে নেওয়া হবে এবং যে সব কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন, তাঁদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এই কয়েকটি দাবি লিখিত প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীদের তরফ থেকে। অথচ, আজও সেগুলি কার্যকর করা হয়নি। ফলে চাষিদের মধ্য থেকে দাবি উঠেছে এমএসপি-কে আইনসঙ্গত করতে হবে, সমস্ত কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে এই এমএসপি চালু করতে হবে। সরকারি সহায়ক মূল্য হতে হবে কমপক্ষে কৃষকের সমস্ত খরচের দেড়গুণ। তা হলে কৃষক খেয়েপরে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু সরকার এই ন্যায়সঙ্গত দাবি মানতে রাজি নয়।

সরকারের বক্তব্য, অত টাকা নেই। অথচ, কর্পোরেট কোম্পানিগুলিকে কর ছাড় দেওয়ার সময় তাদের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব করে দেওয়ার সময় তো টাকার অভাব হয় না। অভাব হয় শুধুমাত্র কৃষকের ফসল কেনার সময়। খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের প্রবেশ করতে দেওয়া চলবে না। সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য নীতি চালু করতে হবে। সার বীজ তেল জল ইত্যাদি সস্তা দরে কৃষককে সরবরাহ করতে হবে, এ ক্ষেত্রে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে ঢুকতে দেওয়া চলবে না।

এর সঙ্গেই কৃষকের ফসল লাভজনক দাম দিয়ে সরকারকে কিনে নিতে হবে, এবং সেই ফসল সস্তা দরে সাধারণ মানুষকে সরবরাহ করতে হবে। একেই বলা হচ্ছে সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য নীতি। কিন্তু সরকার এই নীতি চালু করতে চাইছে না বহুজাতিক কোম্পানি এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। এর ফলে কৃষক সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। কৃষকের ফসল যে দামে বাজারে কেনা হয়, তার তিন-চার গুণ দামে সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। ফলে সাধারণ ক্রেতাদেরও মূল্যবৃদ্ধির কোপে পড়তে হয়।

চাষিরা সময়মতো ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ না পাওয়ার ফলে মহাজনদের কাছে হাত পাততে বাধ্য হন। সার, বীজ, কীটনাশক প্রচুর দাম দিয়ে চাষিকে কিনতে হয়। ডিজ়েল, কেরোসিন, বিদ্যুতের দাম ঊর্ধ্বমুখী। উৎপাদনের আনুষঙ্গিক খরচ যত দিন যায় ততই বাড়তে থাকে, অথচ ফসলের ন্যায্য লাভজনক দাম চাষি পান না। এর উপর খরা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পোকামাকড়ের আক্রমণ, বীজের বন্ধ্যাত্বের কারণে কৃষককে বার বার ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। দেনার দায়ে কৃষককে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। তাই সরকারের কৃষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত। লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলো মানতে গড়িমসি করা ঠিক হবে না।

বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া

অতীতের গহ্বর

‘হেথা নয়... অন্য কোন্‌খানে’ (১০-৭) প্রবন্ধে অনুরাধা রায় পুরনো বঙ্গীয় বামপন্থার পুনরুজীবনের চেষ্টা কেন অর্থহীন, তা বলেছেন। কিন্তু আলোচনা করেননি ‘বামপন্থা’ শব্দটি সম্পর্কে বঙ্গবাসীর বোধ ও অভিজ্ঞতা। নৈতিক সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা অনেক দূরের বস্তু। যে কোনও প্রকারে সংসদীয় ক্ষমতায় টিকে থাকতে ৭-৮টি সাইনবোর্ড-সর্বস্ব বাম দল আশ্রয় নিয়েছিল একটি বড় দলের কোলে। এদের পন্থাগুলি ছিল বিভীষিকার মতো। বশ্যতা স্বীকার না করলে চলত অত্যাচার। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আমরা-ওরার তত্ত্বে। শুধু মধ্যবিত্তরাই নয়, চাপে পড়ে অথবা আখের গোছাতে বহু উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, এবং অনেক বাঙালি বুদ্ধিজীবীও এই বামপন্থার রথে চড়ে বসেছিলেন।

এ কথা ঠিকই যে, নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েটের পতন এবং এ দেশে অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রবেশ বঙ্গীয় বামপন্থীদের বেসামাল করে দিয়েছিল। কলকাতার রাস্তায় কম্পিউটার-বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। লগ্নি-পুঁজির বিরুদ্ধে বন্‌ধ-হরতাল সংস্কৃতিকেই আঁকড়ে ধরেছিলেন বামপন্থীরা। এই সংস্কৃতির চোখরাঙানিতে পুঁজি মুখ ফেরাল। ছোট-বড় উদ্যোগগুলি পাট গোটাতে শুরু করল। ডানলপ, উষা, কৃষ্ণা গ্লাস, জেসপ ইত্যাদি নামগুলি এখন শুধু বাসস্টপ হিসাবেই পরিচিত। যখন ঘুম ভাঙল তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। যে কোনও শর্তে তারা চেয়েছিল ভারতের একটি প্রধান শিল্পগোষ্ঠীকে ডেকে আনতে। কিন্তু তত দিনে আর এক নব্য বামপন্থার উদয় হয়েছে অন্য নামে। ওই শিল্পগোষ্ঠীর বিতাড়নের ইতিহাসকে সামনে রেখে শেষ পর্যন্ত সেই নতুন দলের অভিষেক হল পশ্চিমবঙ্গের সিংহাসনে। অতীত ও বর্তমানের এই কালো গহ্বরগুলি পেরিয়ে বাংলায় ‘নতুন বামপন্থা’র আগমন কোনও দিনই সম্ভব নয়।

তাপস ঘোষ, হাওড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement