এই দেশ আমাদের সকলের।
‘হর ঘর তিরঙ্গা’র এই আনন্দযজ্ঞের পরম গণতান্ত্রিক শুভ ক্ষণে হঠাৎ মনে পড়ে গেল এক জন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের কথা। আজ বেঁচে থাকলে তিনি নিশ্চয়ই এই মহান কর্মযজ্ঞে শামিল হতেন, হয়তো একটু ভিন্ন ভাবে, স্বাধীন ভাবনার দেশপ্রেমী চিন্তায়, সঙ্ঘবদ্ধ শক্তি বা দলচর না হয়েই।
কতই বা বয়স তখন আমার, পাঁচ কি ছয়। সবে স্কুলে ঢুকেছি। হঠাৎই এক দিন শুনলাম স্বাধীনতার প্রথম জয়ধ্বনি। না, তিনি আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন পাশের গ্রামের, মুসলিম পাড়ার। তিনি বিদ্যালয় ছেড়ে গ্রাম পেরিয়ে মূল সংযোগকারী রাস্তা দিয়ে প্রভাতফেরিতে নিয়ে যেতেন তাঁর বাহিনীকে। তখন তো এত শব্দদূষণ ছিল না, গড়ে ওঠেনি এত ঘরবাড়িও। তাই সহজেই কানে ঢুকত এই আওয়াজ। কৌতূহলী মন নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই কানে ঢুকত তাঁর উদাত্ত কণ্ঠ— ভারতমাতা কি..., আর আমারই মতো ছেলেমেয়েরা বলত— জয়। মাঝে মাঝে ধ্বনি উঠত— বন্দে মাতরম্। সত্যি বলতে, যখন তাঁর বলার পরে তাঁর নিজের বিদ্যালয়ের ছাত্ররা জয়ধ্বনি দিয়ে উঠত, তখন খুব হিংসা হত! আমাদের বিদ্যালয়ে কেন হয় না! তাঁর ওই একক ডাকই ছিল আমাদের ওই এলাকার প্রথম প্রভাতফেরি। আমার সমবয়সিদের কাছে স্বাধীনতার কুচকাওয়াজ শোনার প্রথম পাঠ। হয়তো তাঁর দেখাদেখি আমাদের গ্রামের ক্লাবেও শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন। পাড়ার দাদা-কাকারা নিয়ে আসতেন এক টিন বিস্কুট। তখনও আমাদের ওই নিভৃত পল্লিতে বিস্কুট ছিল মহার্ঘ বস্তু।
শিশু বয়সের চাপা পড়া এই ছবি হঠাৎই যুবা বয়সে ভেসে ওঠায় কৌতূহলী মন নিয়ে বুঝতে গিয়েছিলাম তাঁর ভারত চেতনার নিজস্ব বোধ। ওই দিন তাঁর মুখে শুনেছিলাম স্বাধীন ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা উৎকণ্ঠা। তবে বার বার জোর দিয়েছিলেন ‘মানবতা’ শব্দটির প্রতি। কোনও জাতিবিদ্বেষ নয়, দেশবৈরিতা নয়, রাষ্ট্র বিরোধিতা নয়, গড় গড় করে শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতাটি।
স্বাধীনতার মহোৎসবে ঘরে ঘরে ভারতমাতার জয়ধ্বনি দিয়ে পতাকা উঠবে, কুচকাওয়াজে আকাশ-বাতাস মুখরিত হবে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দেশপ্রেমিকদের সীমাহীন দুর্নীতি দেখে মনে হছে তাঁর চেতনায় সুপ্ত শঙ্কা আজ উৎকট ভাবে প্রকাশিত। গরিবের অর্থ লুট করে পাহাড় গড়া ধনের উপর কেউ ডাক দেবেন— আজাদি কা মহোৎসব, উপেনের দুই বিঘা জমি জবরদখল করে রিসর্ট গড়া দেশপ্রেমিক হাঁক দেবেন ‘ভারতমাতা কি জয়’। একই স্লোগান মেলাতে খুব কষ্ট হয়। আজ খুব মনে পড়ছে আমাদের সেই মাস্টারচাচাকে।
বিশ্বজিৎ সরকার , বিউর, বাঁকুড়া
সে কাল-এ কাল
কাঁকড়ার ঝোল সহযোগে মধ্যাহ্নভোজন সেরে, ভেতো এবং দিবানিদ্রা-প্রিয় বাঙালির উদ্গার সহযোগে পরিচিত বাংলা চ্যানেলে অতুলপ্রসাদ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ পর্যায়ের সুরের আবহে রক্ত গরম হয়ে উঠল। মনে পড়ল, দেখতে দেখতে আমাদের দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির দিনটি এসে গেল। ভারতীয়, তথা বাঙালিদের অন্য সমস্ত অভ্যাসের মতো প্রজাতন্ত্র দিবস এবং স্বাধীনতা দিবসও এক ঘোরতর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মনস্তত্ত্বের আঙ্গিক থেকে দেখলে সেটাই বোধ হয় স্বাভাবিক। ছলোছলো চোখে গান-কবিতা-নাটক আর বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ নিয়ে বক্তৃতা, মুখস্থ বুলি আর মাল্যদানের অনুভূতির এক্সপায়ারি ‘টুয়েলভ মিডনাইট’ পর্যন্ত। ২০২২ সালের ভারতবাসীর মনে দ্বেষ মুখ্য, দেশ ও দেশবাসীর প্রতি সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ, সর্বধর্মসমন্বয় ও পরধর্মসহিষ্ণুতার সূক্ষ্মতা মানসমনে দাগ কাটতে অপারগ। তাই আজ ৭৫ বছর পূর্ণ করা স্বাধীন ভারত ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট রাতের উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা অনুভব করতে বিফল হয়, পড়ে থাকে দুমড়ে মুচড়ে থাকা কিছু বিকৃত, বিতর্কিত স্মৃতি।
সুদীর্ঘ ব্রিটিশ শাসনের পর স্বাধীন দেশের ভিত তৈরি হয়েছিল বহু মানুষের আত্মত্যাগ, এবং আরও বহু মানুষের দেশদ্রোহিতা, বিশ্বাসঘাতকতার প্রলেপের উপর দিয়ে। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের ইতিহাস আজ ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন, অথবা সেই সময়কার মানুষগুলোর স্মৃতির সঙ্গে প্রস্তরীভূত। দেশের বহু মানুষের বলিদান, রাজনৈতিক কাটাছেঁড়া ও হিসাবনিকাশ করার পরেও দেশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে রিক্ত, নিঃস্ব করে করুণার দান এই স্বাধীনতা। আমাদের প্রাপ্য স্বাধীনতা।
ধর্মের ভিন্নতা এবং মানুষের দিকদর্শনহীনতাকে কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র শক্তি মুঠোয় রাখতে রাজনৈতিক নেতারা চাল দিলেন, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের কথা না ভেবেই। মানুষ দিশাহারা, বিভ্রান্ত হয়ে ফাঁদে পা দিল। তার সঙ্গে ছিল আগ্রাসী শক্তির উস্কানি। মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী ছিলেন অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি এই ভয়ানক সিদ্ধান্তের প্রভাব আঁচ করতে পেরে সরবে বাংলা ভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। অপরিণত, অপ্রস্তুত ভারতবর্ষের কাছে স্বাধীনতা ও দেশভাগ গোদের উপর বিষফোড়া-সম প্রভাব ফেলেছিল। দেশ জুড়ে জ্বলতে থাকা বিদ্রোহের আগুনে বহু মানুষ আহুতি দিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, সহিংস বা অহিংস, সবাই মিলে নিজ নিজ উপায়ে দেশকে স্বাধীন দেখার জন্য শেষ বিন্দু রক্তটুকু উৎসর্গ করে গিয়েছেন।
ব্রিটিশদের উপর রাগ, ঘেন্না, বশ্যতার পরত পুরু হতে হতে তার উপর জমেছে শেওলা। বহু দিন রাগ, অপমানবোধ অব্যবহারের ফলে তাদের পদাঘাত, লাঞ্ছনা কেমন গা-সওয়া হয়ে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত আনুগত্যবোধ, যা বংশানুক্রমে বহন করে চলেছি আমরা। তাই এখনও ব্রিটিশ টাওয়ার মিউজ়িয়াম, উইন্ডসর প্যালেস, অথবা এডিনবার্গ মিউজ়িয়ামে টিকিট কেটে আমাদের দেশের ঐশ্বর্য, টিপু সুলতানের অস্ত্র, শিরস্ত্রাণ আর এ দেশের মানুষকে দিয়ে তাদের সহনাগরিকদের উপর ব্যবহৃত লক্ষ লক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র দেখলেও আমাদের রক্ত গরম হয় না, চোখ ঝাপসা হয় না। তাই এ আমাদের নস্টালজিয়ার স্বাধীনতা, ভাঙনের স্বাধীনতা, লজ্জার স্বাধীনতা।
প্রপা দে, কলকাতা-৭৮
স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার দিনটি ভারতবাসী হিসেবে প্রত্যেকের কাছেই যেমন আনন্দের, গৌরবের, পাশাপাশি কর্তব্য পালনেরও। প্রায় দু’শো বছর ইংরেজ সরকারের অপশাসন ও শোষণের হাত থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবীরা দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। তার প্রকৃত মূল্য আজ আমরা কতটা দিচ্ছি বা তাঁদের আদর্শ কতটা অনুসরণ করছি, এই প্রশ্নের উত্তরের উপরই নির্ভর করছে বর্তমান তথা ভবিষ্যৎ ভারতের রূপরেখা। নেতাজির মতো দেশনায়করা স্বাধীনতা বলতে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আজ স্বাধীন ভারতের জনগণের তিনটি মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা সকল ভারতবাসীর জন্য হয়েছে? স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সকল ভারতবাসী পেয়েছেন? আজকে ভারতের প্রধান সমস্যা দুর্নীতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়। তার সঙ্গে আছে ধর্মান্ধতা ও জাতপাতের ভেদাভেদ। আজও ভারতে কেন ধর্মনিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক পাঠ্যক্রম চালু হল না? নীতিশিক্ষা বা মূল্যবোধের শিক্ষা বিদ্যালয়ে নেই কেন?
যে কোনও দেশের মূল সম্পদ মানবসম্পদ। শিক্ষার্থীদের যদি আমরা প্রথম থেকেই উপযুক্ত ভাবে তৈরি করতে না পারি, তবে তারা সম্পদ হবে কী ভাবে? বিদ্যালয়ে পাশ-ফেল তুলে দেওয়া কতটা ঠিক হয়েছে, তা আজ শিক্ষার মান দেখলেই বোঝা যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্নগুলো তখনই সফল হবে, যখন আমরা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ করে তুলতে পারব। দেশ আমাদের সকলের। তাই দেশের উন্নতিতে সকলকেই সচেষ্ট হতে হবে।
অভিজিৎ দত্ত , জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ