বইমেলায় গিয়া চালের উপর নাম লিখাইয়া সগৌরবে বাড়ি ফেরেন অনেকে। কালের নিয়মে সেই চাল হারাইয়া যায়, কিন্তু চলন হারায় না। পাথরে নাম লিখিলে সেই নাম ক্ষয় হইয়া যাইতে পারে, কাগজে নাম লিখিলে তাহা ছিন্ন হয়, হৃদয়ে নাম লিখিলে তিন দিনের মধ্যে হোয়াটস্যাপ-এ বিচ্ছেদ-ঘোষণা ফুটিয়া উঠিয়া সেই নাম বিনষ্ট করিতে পারে। সম্ভবত সেই সব ভাবিয়াই, মার্কিন গবেষণা সংস্থা নাসা অন্য পরিকল্পনা করিল। মঙ্গলগ্রহের মাটির গভীরে নজর রাখিবার জন্য আগামী বৎসর তাহারা যে মহাকাশযান পাঠাইবে, তাহাতে একটি সিলিকন মাইক্রোচিপ-এ লিখিয়া পাঠাইবে বহু ইচ্ছুক মানুষেরও নাম। নামগুলি মঙ্গলের মাটিতে চিরতরে থাকিয়া যাইবে। ঘোষণা শুনিয়াই লক্ষাধিক নাম আসিয়া পৌঁছাইয়াছে নাসা-র দফতরে। সর্বাধিক নাম পাঠাইয়াছে আমেরিকা, তাহার পরে চিন, তৃতীয় স্থানেই ভারত। এই ক্ষেত্রে অন্তত চিনের সহিত ভারত টক্কর লইল, কারণ সুজলা সুফলা দেশটিতে সর্বাধিক ফলিয়া থাকে হুজুগ। নিজ নাম মঙ্গলের মাটিতে প্রোথিত থাকিলে কোন সিদ্ধিটি লাভ হইবে, আন্দাজ করা শক্ত। মঙ্গলের অধিবাসী উদ্ভটদর্শন প্রাণী আসিয়া সেই নাম খনন করিয়া, শিশু-মাঙ্গলিকের নাম রাখিবে? না কি, এই আশ্বাস থাকিবে যে আমি মরিয়া যাইলেও আমার নাম মহাবিশ্বের এক ভিন্ন গ্রহে পাক খাইবে? অবশ্য প্রশ্ন তুলিয়া লাভ নাই, বিশ্বই ইদানীং অকিঞ্চিৎকর ও তাৎপর্যহীন কাণ্ডে অধিক উৎসাহী।
নাসার এক বিজ্ঞানী বলিয়াছেন, ইহা মানুষকে মজার ছলে বিজ্ঞানের স্বাদ চাখিতে দেওয়া। মুশকিল হইল, মজার ছলে নাসা-স্তরের বিজ্ঞান হয় না। বিজ্ঞানের ছলে মজা হওয়াও খুব অভিপ্রেত নহে। আর, সকল কিছুকেই মজায় পর্যবসিত করিতে হইবে, অন্তত মজার কক্ষপথ ঘেঁষিয়া আবর্তিত করিতে হইবে, এই দায় বিশ্বের প্রত্যেকের স্কন্ধে কী ভাবে অর্পিত হইল? গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রের চর্চাকারী কেন মজার পরিধি ছুঁইয়া জনপ্রিয় হইতে চাহিবে? নাসা এক সুগম্ভীর সংস্থা, তাহারা মহাবিশ্বের বিভিন্ন দিক লইয়া সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিন্তা ও নির্ণয়কার্যে ব্যাপৃত। সাধারণ মানুষ তারল্যের প্রতি ঝুঁকিয়া থাকিতেই পারেন, কিন্তু নাসা এমন জনতোষী প্রকল্প গ্রহণ করিবে কেন, যাহা অবান্তরতার দীক্ষাকে প্রশ্রয় দিবে? ইহাতে কি মহাকাশবিজ্ঞানের প্রতি মানুষের উৎসাহ বাড়িবে? মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে লোকে অধ্যয়ন শুরু করিবে? কিছুই হইবে না, বরং ফেসবুক-সুলভ মুড়ি-মিছরি-সাম্যবাদের ঘ্রাণ পাইয়া, সকল ‘অধিকারীভেদ’ চূর্ণ করিয়া, এই ক্ষেত্রেও এক ‘মস্তি’বাচক স্রোত ঢুিকয়া পড়িবে। পূর্বে মানুষে জানিত, কিছু ক্ষেত্রে জনতাকে জনার্দন বলিয়া পূজা করা হইলেও, কিছু ক্ষেত্রে তাহাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এবং সেই সকল ক্ষেত্রের চর্চাকারীরা নিজেদের চিন্তন ও প্রবণতাকে মুষ্টিমেয় মানুষের জন্যই গড়িয়া তুলিতেন। গণিতবিদ বা সমাজতাত্ত্বিক কখনওই ক্রিকেটার বা কৌতুকাভিনেতার তুল্য জনস্বীকৃতি লাভের কথা ভাবিতেন না, বা ভাবিলেও সেই আকাঙ্ক্ষাকে জনসমক্ষে মান্যতা দিতেন না। ইহাকে উচ্চনাসাবাদ বলিয়া তর্ক তোলা যাইতে পারে, কিন্তু এই প্রকার ‘নাসা’বাদের তুলনায় তাহা অধিক কাম্য, কারণ পাণ্ডিত্য ও সারশূন্য অগভীর হুজুগকে মিলাইয়া দিবার চেষ্টায় পালে পালে হাঁসজারু উৎপন্ন হইবে, এবং তাহা কোনও গ্রহের পক্ষেই মঙ্গলজনক নহে।