দিল্লির দক্ষিণপ্রান্তের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ফলাফল আদৌ জাতীয় তাৎপর্যের দাবি করিতে পারে কি? পারে, কারণ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে লড়াই কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ছিল না। যে শক্তি গণতন্ত্রের শ্বাস রোধ করিতে চাহে, তাহার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পথেই প্রতিরোধ গড়িয়া তোলা যায় কি না, এই নির্বাচন তাহার পরীক্ষা ছিল। জেএনইউ উত্তীর্ণ হইয়াছে। এবিভিপি-র পরাজয় শুধু সেই সংগঠনের কয়েক জন প্রতিনিধির হার নহে। তাহা একটি রাজনৈতিক পন্থার পরাজয়। ভয় দেখাইয়া, গায়ের জোরে গণতান্ত্রিক পরিসরটিতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের যে কৌশল এবিভিপি গ্রহণ করিয়াছে, শুধু জেএনইউ নহে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাহার নিদর্শনে ক্ষতবিক্ষত। জেএনইউ-এর ক্ষেত্রে সেই তাণ্ডব আরও বেশি হইয়াছে, কারণ প্রতিষ্ঠানটি ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী ও উদার রাজনৈতিক দর্শনের দুর্গ হিসাবেই পরিচিত ছিল। সংঘ পরিবার ঠিক যাহা নহে, জেএনইউ সর্বার্থে তাহাই। অতএব, এই পরিসরটির চরিত্র ধ্বংস করিবার, তাহাকে দখল করিবার জন্য হিন্দুত্ববাদী উগ্র জাতীয়তার ধ্বজাধারীরা সর্বশক্তিতে ঝাঁপাইয়াছিল। এবিভিপি-র পরাজয় বলিতেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র সেই দখলদারিকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। ক্যাম্পাসে মিলিটারি ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করিয়াও যে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চরিত্রভ্রষ্ট করা যাইবে না, নির্বাচনের ফলাফল সেই বার্তা দিল।
দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে গণতন্ত্রের পরিসর নষ্ট করিবার জন্য হিন্দুত্ববাদীরা দ্বিমুখী কৌশল লইয়াছে। এক, যে কোনও বিরুদ্ধ স্বরকেই প্রশাসনিক অস্ত্রে ঘায়েল করিতে চাহিবার প্রবণতা বাড়িতেছে। দুই, যে কোনও আলোচনা, আদানপ্রদানের জন্য যে বাহ্যিক পরিসরের প্রয়োজন, তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইতেছে। ‘মুজফ্ফরনগর বাকি হ্যায়’-এর প্রদর্শনীই হউক বা গণতন্ত্র বিষয়ক আলোচনা, যাহাতে হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক দর্শনে আঘাত লাগিবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা আছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাত তাড়াতাড়ি সেগুলিকে বন্ধ করিতেছেন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গৈরিক বাহিনীর নিয়মিত টহল চলিতেছে বলিয়া অভিযোগ। অর্থাৎ, বৌদ্ধিক এবং বাহ্যিক, এবিভিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের উভয় পরিসরকেই গায়ের জোরে কব্জা করিতে সচেষ্ট। তাহাদের জেহাদ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মুক্ত চিন্তার বিরুদ্ধে। ফলে, চিন্তার পরিসরের দখলও তাহারা লাঠির জোরে লইতে চাহে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের ফলাফল এই লাঠিয়ালদের প্রতি এক সুনির্দিষ্ট বার্তা— হিংসার পথে চিন্তাকে দমন করা যায় না। প্রতিরোধ সংগঠিত হয়। তাহার অভিঘাত সামলাইবার জোর হিংস্রতায় নাই।
সংশয় জাগিতেই পারে যে জেএনইউ ব্যতিক্রম। জেএনইউ-এর ডিএনএ-তে এই প্রতিরোধ আছে। কথাটি সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নহে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ আসিলে প্রথম প্রতিরোধ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতেই তৈরি হয়। এক ক্যাম্পাস হইতে সেই প্রতিরোধের অগ্নিশিখা অন্য ক্যাম্পাসে ছড়াইয়া পড়ে। ইহাই ইতিহাসের পথ। আশাবাদী হওয়া যায় যে ভারতেও দখলদারি প্রতিষ্ঠার গৈরিক অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দৃঢ়তর হইবে। তবে, দখলদারি কিন্তু শুধু হিন্দুত্ববাদীরাই করে নাই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কী ভাবে বিরোধীশূন্য রাখিতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা তাহার প্রামাণ্য পাঠ্যপুস্তক লিখিতে পারেন। তৃণমূল কংগ্রেসও ধারাটি বজায় রাখিয়াছে, বস্তুত তাহাকে কদর্যতর করিয়াছে। বিজেপির পথটি উগ্র গা-জোয়ারির বলিয়া দৃষ্টিকটু হইতেছে। তাহারা বামপন্থীদের হইতে দখলদারির সূক্ষ্মতা শিখিতে পারে। তবে, সেই দখলদারির পরিণতি কী হয়, রাজ্যের বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির দশা দেখিয়া সে পাঠ লইলেই এবিভিপি-র মঙ্গল।