সম্ভবত এই বৎসরের শেষ প্যাকেজটি ঘোষণা করিয়া দিলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। মার্চ হইতে নভেম্বর, সাড়ে সাত মাসে ঘোষিত তিনটি প্যাকেজ ও অন্যান্য সংস্কার-সিদ্ধান্তে সরকারের অর্থনৈতিক দর্শনটি প্রশ্নাতীত রকম স্পষ্ট— তাঁহারা মানুষের হাতে নগদ দিয়া বাজারে চাহিদা ফিরাইবার নীতিতে বিশ্বাসী নহেন, বরং এমন পরিবেশ তৈরি করিতে চাহেন, যাহাতে চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্রশ্ন হইল, সরকার সেই কাজটিও ঠিক ভাবে করিতে পারিয়াছে কি? মার্চ বা মে মাসের প্যাকেজে যে তাহা হয় নাই, তাহা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, সম্প্রতি যে বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি দেখা যাইতেছে, তাহাই কি সরকারি প্যাকেজের সাফল্যের প্রমাণ নহে? না, কারণ পরিসংখ্যান বলিতেছে, অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে পারিবারিক সঞ্চয়ের হার বৃদ্ধি পাইয়াছিল— তখন খরচ করিবার উপায় ছিল না বলিয়াই— লকডাউন উঠিবার পর সেই টাকা খরচ হইয়াছে। এখন ভারতে উৎসবের মরসুম বলিয়াও খরচ বাড়িয়াছে বলিয়াই বিশেষজ্ঞদের অনুমান। আয়ের হার বৃদ্ধি না পাওয়ায় এই চাহিদাও পরবর্তী ত্রৈমাসিকে টিকিবে কি না, প্রশ্ন থাকিতেছে।
কিন্তু, মার্চ অথবা মে মাসের সহিত নভেম্বরের পরিস্থিতির তুলনা চলে না। অর্থব্যবস্থা এখন তুলনায় অনেক বেশি সচল। এই পরিস্থিতিতে ঘোষিত প্যাকেজে কর্মসংস্থানের উপর যে জোর দেওয়া হইয়াছে, তাহা সময়োপযোগী। গৃহনির্মাণ ক্ষেত্রটিতে দেশে কৃষির পরই সর্বাধিক কর্মসংস্থান হয়— ফলে, সেই ক্ষেত্রে বিবিধ ছাড় ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ায় তাহা কর্মসংস্থান বাড়াইতে পারে বলিয়াই আশা। বস্তুত, গৃহনির্মাণ ক্ষেত্রে চাহিদা বাড়িলে তাহার প্রভাব আরও অনেকগুলি ক্ষেত্রের উপর পড়িবে। তাহা ভিন্ন, ২৬টি নূতন ক্ষেত্রে সুলভ ঋণের ব্যবস্থা করাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, কিছু প্রশ্নও থাকিয়া যাইতেছে। উৎপাদন-কেন্দ্রিক প্রণোদনার যে সিদ্ধান্তটি সরকার ঘোষণা করিয়াছে, তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে দীর্ঘমেয়াদি। ফলে, এখনই অর্থব্যবস্থার উপর তাহার কী প্রভাব পড়িবে, সেই সংশয় আছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা সরকার মিটাইয়া দিবে, এই প্রতিশ্রুতিও কি কর্মসংস্থান বাড়াইতে পারিবে? এই ভর্তুকি পাইতে হইলে মাসে মাসে নূতন শ্রমিক নিয়োগ করিয়া চলিতে হইবে, এমন দাবিও ভয়ঙ্কর, কিন্তু সে আলোচনা অন্যত্র। কোভিড-১৯’এর টিকা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বরাদ্দ নয় শত কোটি টাকাকেও ‘স্টিমুলাস’ বলিয়া দাবি করিয়াছে সরকার। প্যাকেজের পরিমাণ বাড়াইয়া দেখাইবার এই তাড়নাটি দৃষ্টিকটু।
নির্মলা সীতারামন এই প্যাকেজেও ধারাবাহিকতা বজায় রাখিয়াছেন— অর্থাৎ, প্যাকেজ আছে, কিন্তু টাকা নাই। বিভিন্ন ঋণ, ছাড় ইত্যাদিতেই তিনি প্রণোদনার ডালা সাজাইয়াছেন। অর্থব্যবস্থা বর্তমান যে অবস্থায় আছে, তাহাতে এই ‘অর্থ’হীন প্যাকেজ সফল হইবে কি না, সংশয় থাকিয়াই যায়। এখানেই দূরদৃষ্টির অভাব প্রকট হইয়া উঠে। কোভিড ও লকডাউনের ধাক্কায় যখন পরিস্থিতি টালমাটাল ছিল, বিশেষত নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে তীব্র আর্থিক অনিশ্চয়তা ছিল, তখন যদি অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ মানিয়া সরকার নগদ টাকার ব্যবস্থা করিত— যাহাকে কেন্সীয় দাওয়াই বলা হইয়া থাকে— তবে আজ বাজারের চাহিদার জন্য এতখানি ভাবিতে হইত না। বাজারের শিরা-ধমনীতে টাকার জোগান থাকিত। এবং, এখন যে আর্থিক নীতিগুলি ঘোষণা করা হইতেছে, সেগুলি অনেক বেশি কার্যকর হইত। তাঁহারা অর্থশাস্ত্রের একটি প্রাথমিক পাঠে ভুল করিয়াছেন— মন্দার কবল হইতে নিস্তার পাওয়ার যে পথ, তাহার ধাপগুলি গুরুত্বপূর্ণ। ভুল সিঁড়িতে পা ফেলিলে পতনের সম্ভাবনা প্রবল। মে মাসের ভুলের মাসুল নভেম্বরে দিতে হইবে, এই সম্ভাবনাটি সরকারেরই তৈরি করিয়া লওয়া।