হাসপাতাল চত্বরে এ ভাবেই পড়ে থেকে মৃত্যু হয়েছিল বৃদ্ধের। —ফাইল চিত্র।
চিকিৎসার ব্যবস্থা হইয়াছিল, অ্যাম্বুল্যান্স আসিয়াছিল, পরিবার-পরিজনও উপস্থিত ছিলেন। তবুও বনগাঁর পঁয়ষট্টি বৎসরের বৃদ্ধকে বাঁচানো যায় নাই। সকলের সম্মুখে, অ্যাম্বুল্যান্সের সামনে রাস্তায় পড়িয়া তাঁহার মর্মান্তিক মৃত্যু হইয়াছে। চিকিৎসার অভাবে নহে, সহমর্মিতার অভাবে। অসুস্থ মানুষটিকে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠাইয়া দিবার জন্য কেহ হাত বাড়াইয়া দেন নাই। কারণ, তিনি ‘কোভিড রোগী’। এবং কোভিড-১৯ এমনই এক ভয়াবহ অতিমারির নাম, যাহা শরীরের তুলনায় বহু গুণ দ্রুততায় মানুষের মনকে আক্রান্ত করিয়াছে। এক অনিশ্চিত জীবনে প্রবেশ করিয়া মানুষ তাহার সহজাত অনুভূতি ভুলিয়াছে, এবং ভুলিয়াছে মানবিকতাবোধ। সুতরাং, এই পর্যায়ে দাঁড়াইয়া বৃদ্ধের মৃত্যুর ঘটনাটিকে ব্যতিক্রমী বলিবার উপায় নাই।
আচরণগত এই পরিবর্তনের লক্ষণগুলি রাতারাতি দেখা যায় নাই, বহু দিন ধরিয়াই সমাজে পরিলক্ষিত হইতেছিল। বিশ্বায়নের যুগে ‘ভার্চুয়াল’ দুনিয়ায় মানুষের বিচরণ অনায়াস হইয়াছে সত্য। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে সে আত্মকেন্দ্রিকতাকে ক্রমশ আপন করিয়া লইয়াছে। দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির কাতরোক্তি উপেক্ষা করিবার অথবা সহযাত্রী মহিলার শ্লীলতাহানি দেখিয়া চুপ থাকিবার ন্যায় অজস্র উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীতে দেখা গিয়াছে। তবে মার্চ, ২০২০ সালের পূর্বাবধি তাহাকে মোটের উপর ব্যতিক্রম বলিয়া ধরিয়া লওয়া হইত। আশা করা চলিত, মানবিকতাবোধ সমাজ হইতে সম্পূর্ণ উবিয়া যায় নাই, স্বল্প হইলেও তাহা আছে। কিন্তু অতিমারি এবং তজ্জনিত বিশ্বজোড়া লকডাউন সেই ভাবনায় বিরাট পরিবর্তন আনিল। এত কাল যাহা প্রচ্ছন্ন ছিল, সেই আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা তুঙ্গে উঠিল। যেন নিজ গণ্ডিটুকু নিরাপদ রাখা এবং নিজ স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করাই একমাত্র অভীষ্ট। কেহ লকডাউনের পূর্বে অর্থের জোরে দোকানের অর্ধেক সামগ্রী কিনিয়া ভাঁড়ার ভরাইতেছেন, কেহ পাড়ায় চিকিৎসাকর্মীদের তাড়াইতেছেন, কেহ আবার করোনা-আক্রান্ত প্রতিবেশীর সঙ্গে কুশল-সংবাদ বিনিময়টুকুও বন্ধ করিতেছেন। স্থানবিশেষে তাহা হিংস্রতায়ও পর্যবসিত। করোনা-আক্রান্তের সন্ধানে আসিয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রচণ্ড প্রহৃত হইবার ঘটনাও ঘটিয়াছে।
অর্থাৎ, জীবনভাবনার স্বাভাবিক ছন্দটি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হইয়াছে। হইবার যথেষ্ট কারণও আছে। বিগত ছয় মাস ধরিয়া গণমাধ্যমগুলিতে অতিমারি ভিন্ন অন্য সংবাদ প্রায় নাই। প্রায়শই সংক্রমণ লইয়া নূতন আশঙ্কার কথা শুনা যাইতেছে। আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় প্রতি দিনই নূতন রেকর্ড গড়িতেছে। ইহার যেন শেষ নাই। জীবন লইয়া এই ক্রমাগত অনিশ্চয়তা-বোধ মানসিক স্থিতি নষ্ট করিয়া দেয়। এইখানেই প্রশাসন এবং গণমাধ্যমগুলির এক গুরুদায়িত্ব রহিয়াছে। জনগণকে আশ্বাস দিবার দায়িত্ব। বিশেষজ্ঞরা যে কথাগুলি বলিতেছেন— সময়ে রোগ ধরা পড়িলে নবতিপরও এই রোগে সুস্থ হইয়া উঠেন, ইহাতে আতঙ্কিত হইবার কিছু নাই, সেই কথাগুলিই বারংবার জোর দিয়া প্রচার করিতে হইবে। এবং একই সঙ্গে সমাজমাধ্যমে নিরন্তর যে গুজবগুলি ঘুরিতেছে, তাহার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা করিতে হইবে। দায়িত্ব আরও আছে। প্রত্যেক রোগী যাহাতে সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা পাইতে পারেন, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হইলে আচরণেও অচিরেই তাহার প্রভাব পড়িবে।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)