পুজোয় তা হলে কাশ্মীর

এই পতাকা ১৯৫২ সালে রীতিমতো নেহরু ও শেখ আবদুল্লা ‘দিল্লি এগ্রিমেন্ট’-এর ফলে গৃহীত হয়েছিল, যেমন ভাবে দেশভাগের সময় গৃহীত হয়েছিল আমার বা আপনার দাদুর বাড়িটা, এখন বাংলাদেশে। এ ব্যাপারে আমারও যেমন কিছু করার নেই, আফসানা ফারুকেরও কিছু করার নেই। 

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৯ ০২:৫২
Share:

কাশ্মীর নিয়ে আমাদের, কাশ্মীর সংলগ্ন ভারতের অন্য লোকেদের মতো উদাসীনতাই ছিল স্বাভাবিক। অন্তত এত দিন পর্যন্ত। সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ধারার রদবদলের পরে এই অবস্থার আচমকা পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা প্রত্যেকেই ভীষণ উৎসুক হয়ে উঠেছি, কাশ্মীরের অতীত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। বর্তমানের বিষয়টা ইন্টারনেটের যোগাযোগের কারণে একটু ব্যাহত।

Advertisement

আমরা এত দিন উদাসীন ছিলাম কেন? এমন তো নয় কাশ্মীরের সম্পর্কে কোনও খবর আমাদের কাছে এসে পৌঁছত না। সেনাবাহিনীকে তাড়াতে পাথর ছুড়ছে কাশ্মীরি মহিলা-পুরুষ, সেই পাথর থেকে বাঁচতে সেনার ‘রক্ষক’ জিপের সামনে কাশ্মীরি শিল্পী ফারুক আহমেদ দারকে বেঁধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। বরফঢাকা কাশ্মীরের পথঘাট পরিষ্কার করছে সেনাবাহিনী, বুট পায়ে কাঁটাতারে টহলও চলছে অবিরত। চেনামুখ নাবালক অভিনেতাকে জঙ্গি সন্দেহে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, তার পর জঙ্গি নেতা সেনাবাহিনীর গুলিতে হত, শোকজ্ঞাপন করছে সারা উপত্যকা— এই সব খবর কাগজের সামনের পাতাতেই ফুটে ওঠে। তবু আমাদের খুব একটা যেত-আসত না। কারণ কাশ্মীরে মিলিটারির কাছে ২৭৩০টি বেনামি কাশ্মীরি মৃতদেহ পাওয়া যাক, বা তারা এক রাতে কুনান পোশপোরা গ্রামের প্রায় ১০০ জন মেয়েকে ধর্ষণ করুক, বা প্রায় ২০০০০ জন কাশ্মীরি নিখোঁজ হোন, আমাদের রোজকার জীবনে কিছু হেরফের হয় না। খুব বেশি হলে পরিচিত কাশ্মীরি শালওয়ালাকে দু’একটা আহা-উহু, বা নিউ মার্কেটের কাশ্মীরি দোকানদারকে ‘আপনাদের ওখানে যা চলছে’ ধরনের কথা বলতে পারি।

আর যদি উল্টোটা হয়? কাগজে বেশি পাথর ছোড়ার ছবি-টবি না আসে, ট্রাভেল এজেন্ট সোশ্যাল মিডিয়া খবর দেয় কাশ্মীরের অবস্থা মোটামুটি ভাল? কাশ্মীরটা দেখা হয়নি, এলটিসিও জমে— কাশ্মীর যাওয়া যায় কি না ভাবি।

Advertisement

এ বার পুজোয় তা হলে কাশ্মীর? এ বার পুজোয় না হোক, অন্তত পরের পুজোয় মনে হচ্ছে নিশ্চিন্তে কাশ্মীর যাওয়া যাবে। সংবিধানের যে ধারাই হোক না কেন, ওঁদের যথেষ্ট ‘টাইট’ দেওয়া গিয়েছে সে নিয়ে সন্দেহ নেই।

এক সপ্তাহ ধরে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ তো তেমনই বলছে। কী উচ্ছ্বাস, কী আনন্দ। সংবিধানের কোনও বিশেষ ধারা সম্পর্কে আমাদের যে এত জ্ঞান ছিল, আমরা রাজা হরি সিংহ বা মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কে এত জানতাম— নিজেরাই কোনও দিন জানতে পারিনি। কাশ্মীরের লোকেরা যে কোনও কাজ করেন না, শুধু ঢিল ছোড়েন— কাশ্মীরি কারুকাজ করা পোশাক কেনার সময় ভাল করে খেয়াল করিনি। তা ছাড়া যে রাজ্য বা অঞ্চলে বিশেষ ধর্মের মানুষের আধিক্য, তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করাটা এখন আমরা একটি জাতীয় কর্তব্য মনে করছি। কাশ্মীরি মানেই মুসলমান, কাশ্মীরি মানেই পাকিস্তানের লোক, কাশ্মীরি মানেই জঙ্গি। সুতরাং তাঁদের শাস্তি হবে না তো কাদের হবে? কেমন ‘আমাদের’ হিন্দু পণ্ডিতদের তাড়িয়েছিল এক সময়? বেশ হয়েছে। আর কাশ্মীরে ওঁদের আলাদা পতাকার ব্যাপারটা তো আছেই।

এই পতাকা ১৯৫২ সালে রীতিমতো নেহরু ও শেখ আবদুল্লা ‘দিল্লি এগ্রিমেন্ট’-এর ফলে গৃহীত হয়েছিল, যেমন ভাবে দেশভাগের সময় গৃহীত হয়েছিল আমার বা আপনার দাদুর বাড়িটা, এখন বাংলাদেশে। এ ব্যাপারে আমারও যেমন কিছু করার নেই, আফসানা ফারুকেরও কিছু করার নেই।

আফসানা ফারুক ১৪ বছরের মেয়ে। ভয়ঙ্কর আহত হয়ে শ্রীনগরের হাসপাতালে। কোনও মতে যে সব ছবি এসে পড়ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে, সেখানে আমরা দেখতে পেয়েছি আফসানা ফারুককে। আমাদের জানতে দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু উপত্যকাকে তটস্থ রাখতে মাঝে মাঝেই গুলির ছররা বর্ষণ করছে সেনাবাহিনী। সেই হুড়োহুড়িতে পড়ে গিয়েই লোকের চাপে প্রায় থেঁতলে গিয়েছে আফসানার মুখ। অবশ্য ও একা নয়, এ রকম অনেকেই পদপিষ্ট হচ্ছেন।

শুধু তা-ই নয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আমাদের জানাচ্ছে যে এখনও কাশ্মীর কার্যত গৃহবন্দি। হাজার হাজার ভারতীয় সেনা রাস্তা, স্কুল কলেজ, এমনকি মানুষের বাড়ির ছাদও আটক করেছে। শুধু গুলির ছররা নয়, ক্রমাগত ছোড়া হচ্ছে কাঁদানে গ্যাসও। কাশ্মীরের রাস্তায় অসংখ্য প্রতিবাদের মিছিলদের স্তব্ধ করছে।

সদ্য পালিত হল কোরবানি ইদ। সবেমাত্র ইদের বাজার করতে বেরিয়েছিলেন মানুষ, এমন সময় আবার ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তাড়া খাওয়া পশুর মতো তাঁদের ঢুকে পড়তে হয় ঘরে।

গৃহবন্দি, বিধ্বস্ত, আত্মীয়পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগহীন কাটল তাঁদের উৎসব। তাঁদের পক্ষে কথা বলার জন্য কেউ নেই। সংসদে বিরোধীদের যথেষ্ট সংখ্যা নেই, অবস্থা দেখার প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি সাংসদ ডি কে রাজা, সীতারাম ইয়েচুরিকে। নিরপেক্ষ মিডিয়ার অবস্থান সেখানে সহজেই অনুমেয়। মেহবুবা মুফতির কন্যা ইলতিজা ইকবালের মর্মস্পর্শী লেখা কোনও মতে আমাদের হাতে এসে পড়ে, জঁ দ্রেজ়ের মতো আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ান।

এইটুকুই। আমরা আফসানা ফারুককে দেখতে পারছি না, ইলতিজাকেও নয়, স্তব্ধ হওয়া ইদও নয়। প্রায় রাতের অন্ধকারে আমাদের দেশকে দু’টুকরো করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল আবারও, তাতেও কিছু এসে যায় না।

যেমন উরি, যেমন পুলওয়ামা, তেমনই কাশ্মীর। এ বার না হোক, পরের পুজোয় নিশ্চিন্তে কাশ্মীর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement