আমেরিকায় কেবল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনপর্ব নয়, শেষ বেশ কয়েকটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তাদের গণতন্ত্রের মডেলটিতে কালি লেপে দিয়েছে। তার আগের ভাবমূর্তি আর ফিরবে না। গণতন্ত্রের ধ্বজাবহনের সঙ্গে যে নৈতিক নেতৃত্বের অধিকারটি জড়িত, সেও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আপাতত আমেরিকার গণতন্ত্র যেন ছন্নছাড়া, নিজের ভুল-ত্রুটিতে নিজেই ধুঁকছে। ২০২০-র নভেম্বরে গোটা বিশ্ব ঘোর অবিশ্বাস আর চূড়ান্ত অভক্তি নিয়ে মন দিয়ে দেখল ভোটপ্রক্রিয়া। গণতন্ত্রের সোপানে একেবারে শেষ ধাপে যে সব দেশ, তারা পর্যন্ত আমেরিকার ভোট-ভোগান্তি দেখে আনন্দ আর অবজ্ঞা চেপে রাখতে পারল না।
ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই বললেন, ‘দারুণ ব্যাপার!’ নিজের দেশের শাসনব্যবস্থাকে পিছিয়ে রেখে তামাম দুনিয়ায় নাম কিনেছেন খামেনেই। তিনি এ বার টুইট করলেন, “আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে ‘অসুরক্ষিত’ ভোট হয়েছে এ বারে। যে প্রেসিডেন্ট এখন দেশ চালাচ্ছেন, তাঁর বিরোধীরা বলছেন প্রেসিডেন্ট ভোটে রিগিং করতে চাইছেন! এই তো আমেরিকার নির্বাচন, গণতন্ত্রের হাল।”
পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শপথ নেবেন আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি। তিনি বলেছেন, তিনি নির্বাচন লড়েছেন “আমেরিকার আত্মাকে রক্ষা করতে, জাতির মেরুদণ্ড মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে পুনর্গঠিত করতে, বিশ্বের আঙিনায় আমেরিকাকে ফের সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে এবং দেশের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে।” মুশকিল হল, এই সবই করার চেয়ে বলা ঢের সোজা। দুনিয়ার চূড়া থেকে এক বার পিছলে গেলে, সেখানে আবার উঠে আসা প্রায় অসম্ভব। বাইডেনদের বিশ্ববীক্ষায় ভীষণ বাসি গন্ধ। তাঁরা যে আমলের কথা ভাবছেন, সেই আমল সম্ভবত চিরতরে অস্ত গিয়েছে। আমেরিকার দাদাগিরির সেই সোনারঙের দিনগুলি নিয়ে বিশ্বে কারও কিছু এসে যায় না। দেশের ভিতরেও কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাইডেন এবং উদারচেতা আমেরিকানরা আকুলিবিকুলি করে এই আদর্শটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে গেলে আতান্তরে পড়বেন।
গণতন্ত্র, উদারনীতি ও সাম্যের যে মতাদর্শ নিয়ে আমেরিকা এক কালে গালভরা বাণী শোনাত, এই মুহূর্তে বিশ্বদুনিয়াকে সে সব বিশ্বাস করানো অসম্ভব কঠিন। আস্থা এক বার হারিয়ে গেলে তাকে ফেরত পাওয়া সোজা কাজ নয়। সিসিফাসের পাথরের মতো কেবলই তা গড়িয়ে খাদে পড়ে যেতে থাকে।
বহু কাল ধরে আমেরিকা তার এই নীতিপরায়ণ ভাবমূর্তিটি ভাঙিয়ে ভূ-রাজনৈতিক অভীষ্টসিদ্ধির পথে এগিয়েছে। আমেরিকানদের জীবনচর্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে, সভ্যতার আলোর দিকে এগিয়ে চলার বুলি আওড়েছে। সেই সমস্ত গল্পের গাড়ি এখন থমকে গিয়েছে।
আগামী দিনে নীতির এই আলোকবর্তিকা তবে কার ঘর থেকে মিলবে? আমেরিকার গণতান্ত্রিক আদর্শ ভেঙে পড়েছে, তাতে সন্দেহের মরচে। ইউরোপ আত্মসম্মান ফেলে অন্যের তোষামোদে ব্যস্ত, নিজের ঘরে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় ও জাতিগত বিভিন্নতা নিয়ে নাজেহাল। এমতাবস্থায় পৃথিবীর রোলমডেল হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, ক্ষমতার সিঁড়িতে লাফ মেরে উঠছে কিছু স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র। যেমন, গণপ্রজাতন্ত্রী চিন। এমনধারা বিকাশে ভবিষ্যতের আকাশে ঘোর সঙ্কট। এখনই কোনও সুস্থ বিকল্প মেলা প্রয়োজন। জীর্ণ আদর্শ আর রুগ্ণ ব্যবস্থার ভিড়ে পৃথিবীর মুখ ঢেকে গিয়েছে। সেই বিজনভূমে সত্যিকারের বিকল্প নেতা কোথায়?
সিঙ্গাপুরের প্রখ্যাত কূটনীতি-শিক্ষাবিদ কিশোর মধুবনী একটি অভাবনীয় নাম উচ্চারণ করেছেন এই প্রসঙ্গে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এ সম্প্রতি তিনি লিখেছেন, “ভূ-রাজনৈতিকগত ভাবে ‘সুইট স্পট’-এ এসেছে ভারত। অর্থাৎ? বিক্ষুব্ধ এই গ্রহের নৈতিক উপদেষ্টার প্রয়োজনে এখন বিশ্ব জুড়ে স্বতন্ত্র, মজবুত স্বরসন্ধান চলছে। বাস্তব বিচারে, ভারতই একমাত্র এই পদের যোগ্য। পদটির জন্য বাকি যে তিনটি নাম ওঠে, আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও চিন— কেউ এখন এই গুরুদায়িত্বের উপযুক্ত নয়।”
“ভারতের এই উদয় আশ্বাসজনক। কারণ, অন্যান্য শক্তি এতে শঙ্কিত বোধ করবে না। এই বিশ্বাসের জায়গাটার সুবাদে বিশ্বের নৈতিক নেতৃত্বভার তুলে নেওয়ার ভাল সুযোগ রয়েছে ভারতের সামনে। বেঁচে থাকলে আজ যেমনটা করতেন মহাত্মা গাঁধী।” মধুবনী আরও লিখেছেন, বহুপাক্ষিক নীতি ও নিয়মমাফিক আচরণের ক্ষেত্রে বিশ্বের সামনে চমৎকার উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে ভারত।
কিন্তু কোভিড-১৯ অতিমারি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও লাগাতার অর্থনৈতিক সঙ্কোচনের ফলে ভারতের অভ্যন্তর স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা আর নৈরাশ্যের বেদনায় ছেয়ে গিয়েছে। বিশাল সংখ্যক চাকরি গিয়েছে, অর্থনীতি টলোমলো, সরকারি সঞ্চয় উবে যাচ্ছে। গোটা জাতি দিশেহারা, হতোদ্যম।
ভারতের অন্তরপ্রকৃতিও আজ তীব্র ভাবে খণ্ডবিখণ্ড, বিপরীত মেরুতে বিভক্ত। এই মুহূর্তে এমন একটি দেশের মধ্যে কে-ই বা ভবিষ্যতের রোল মডেলকে দেখতে পাবে? তবুও, মধুবনীর মতে, পৃথিবীর নীতিধ্বজা বহনের ক্ষমতা ভারতের আছে। কিন্তু নীতির নেতা হয়ে উঠতে আগে তো চাই এক জন ঠিকঠাক দেশনেতা। উদারচেতা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক। যিনি সকলকে নিয়ে চলতে পারেন। যিনি এই বিরাট বিচিত্রধর্মী জাতিরাষ্ট্রকে একসূত্রে বাঁধার ক্ষমতা ধরেন।
ভারত কি শুনছে এ সব?