জেমস আর্থার বল্ডউইন।
রোগক্লিষ্ট পৃথিবী আর ভবিষ্যতের নৈরাশ্যের মাঝখানে আমেরিকার মাটিতে নতুন করে আলাপ হল জেমস বল্ডউইনের সঙ্গে। যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আওতায় আমেরিকায় আসা হয়েছে, তার শর্ত অনুযায়ী ভারতীয় সংস্কৃতির ব্যাপারে যেমন আলোচনা চালাতে হবে, তেমনই আমেরিকান সংস্কৃতি সম্বন্ধে নানা ভাবে জানতেও হবে। যে অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে সেই সংস্কারশিক্ষা চলছে, তিনি এক দিন জানালেন জেমস আর্থার বল্ডউইনের লেখা কী ভাবে তাঁর জীবনবোধ পাল্টে দিয়েছে। হিংসা আর মানবতার অবক্ষয় রোজ দেখেও আমরা নৈরাশ্যের পূজারি হতে পারি না। বল্ডউইন আশির দশকে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে জানিয়েছিলেন, নৈরাশ্যবাদী হওয়ার বিলাসিতা তিনি দেখাতে পারেন না, কারণ তিনি জীবিত। মৃত মানুষ নিরাশার দীর্ঘ সাক্ষ্য প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে বলেই জীবিতকে আশার কথা অক্লান্ত বলে যেতে হবে।
১৯৬২-র তীব্র শীতের রাতে জেমস বল্ডউইন একটা চিঠি লিখলেন তাঁর ভাইপোকে। যার প্রতিটি শব্দ, এমনকি যতিচিহ্নও ইতিহাসের এক-একটা ছত্র যেন। ভাইপোর নামও জেমস, লিখলেন:
“প্রিয় জেমস, এই চিঠি আমি বার পাঁচেক লেখা আরম্ভ করে ছিঁড়ে ফেলেছি। তোমার মুখের দিকে বার বার তাকিয়ে দেখি আমি, সে মুখে তোমার বাবা আর আমার ভাইয়ের মুখচ্ছবি মিশে আছে। তোমাদের দু’জনের গোটা জীবনের সাক্ষী আমি। তোমার বাবা আমার কোলেপিঠে বড় হয়েছে, ওর কপালে চুমো দিয়েছি। আমার চোখের সামনে হাঁটতে শিখেছে ও। জানি না তুমি কাউকে এ ভাবে আজন্ম চিনতে পারবে কি না, এতটা ভালবাসার সুযোগ পাবে কি না। এমন ভাবে কাউকে বড় হতে দেখলে সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনযন্ত্রণা আর কাতরতা নিয়ে অদ্ভুত এক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। পৃথিবী আমার ভাইয়ের সঙ্গে আরও অনেকের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছে আমি তা জানি। এই দীর্ঘ অপরাধের অপরাধী আমারই দেশের মানুষ। তারা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়েছে, এখনও ধ্বংসের খেলা খেলে চলেছে।
মানুষকে তবুও মৃত্যু আর অবক্ষয়ের দিকে দার্শনিকের দৃষ্টিতে তাকাতে হবে, অন্তত তাকানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। যুদ্ধের পর থেকে মানবজাতির বেশির ভাগই এই সাধনা করে চলেছে। লক্ষ করো, আমি ‘বেশির ভাগ’ বলেছি: সবাই নয়। তবু এটাও স্বীকার করে নেওয়া যাবে না যে, মৃত্যু আর ধ্বংসের নির্মাতারা সবাই নিরীহ। তাদের আপাত নিরীহপনা থেকেই জন্ম নেয় যত অমানবিক অপরাধ।
মনে রেখো জেমস, চার পাশের নিরীহ নির্দোষ দেশবাসী তোমার জন্য একটা কল বানিয়ে রেখেছে। সেই কলের মধ্যে জন্ম থেকেই তুমি আটকা পড়ে আছো, সেই সমস্ত পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝে যাচ্ছ যেমনটা আমরা চার্লস ডিকেন্সের একশো বছর আগেকার লন্ডনে দেখতাম। ওরা তো তোমাকে মানুষ বলেই গণ্য করে না। আমরা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠেছি, এখনও কাঁপি। তবু পরস্পরকে ভালবাসতে পেরেছিলাম বলে আজও টিকে আছি, তুমিও থাকবে। আমাদের সবার ভালবাসা তোমার সঙ্গে আছে। তোমার উত্তরাধিকারের জন্য, তাদের সন্তানদের জন্য তোমায় বেঁচে থাকতে হবে।
এই ‘নিরীহ’ দেশ তোমার জন্য একটা বস্তি বরাদ্দ করেছে। মনে করেছে, সেখানেই তিলে তিলে মরবে তুমি। তোমার জন্ম আর ভবিতব্যের পিছনে অজুহাত ঠিক হয়েছে একটাই— তোমার গায়ের রং। ওখানেই তোমার স্বপ্নের সীমা নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে। তোমার সমাজ রোজ রোজ নির্মম ভাবে তোমাকে বুঝিয়ে গিয়েছে, মানুষ হিসেবে কোনও যোগ্যতাই তোমার নেই। উৎকর্ষের পথে এগিয়ে চলার নেই অধিকার। তোমাকে সারা জীবন মধ্যমেধার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে। জেমস, সারা জীবনের জন্য তোমার গণ্ডি আঁকা হয়ে গিয়েছে। তবু মনে রেখো, পৃথিবীতে এসেছ মানে তুমি যে কোনও উচ্চতা অবধি পৌঁছতে পারো। মনে রেখো, ওদের দাগিয়ে দেওয়া পরিচয়ে তোমার অপারগতা প্রমাণ হয় না, বরং ওদের অমানবিকতা আর ভয় ফুটে উঠে।
জেমস, সবচেয়ে কঠিন কাজটা হল তোমাকে ওদের গ্রহণ করতে হবে, সৌহার্দের সঙ্গে। ইতিহাস ওদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস করানো হয়েছে কালো চামড়ার মানুষের জায়গা সাদা চামড়ার নীচে। সাদা চামড়ার পৃথিবীতে কালো মানুষের অবস্থান নিশ্চল এক তারার মতো, অটল পাথরের মতো। সে তার বরাদ্দ গণ্ডির বাইরে এলেই স্বর্গ-মর্তের ভিত নড়ে যায়। তবু অখণ্ডতায় আস্থা রেখো। মহান মানুষেরা এখানে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন, আবারও দেবেন। তাঁদের হাত ধরেই আমরা আমেরিকাকে যোগ্যতর আমেরিকা বানিয়ে তুলব, যেমনটা হওয়া উচিত ছিল।
রাস্তা কঠিন হবে, কিন্তু তুমি এসেছ প্রতিকূলতার সাক্ষী হয়েই। বলিষ্ঠ হাতের চাষারা তুলো কুড়িয়েছে, নদীতে বাঁধ দিয়েছে, নিজে হাতে রেলপথ বা রাস্তা বানিয়েছে। তাদের সবার প্রতিনিধি তুমি। যারা শত বাধার সামনেও আত্মমর্যাদা হারায়নি। সেই হোমার থেকে আরম্ভ করে কত সহস্র কবির ভাষার ধারক তুমি। তাদের এক জন বলেছে, ‘ঠিক যখনই ভাবি আমি গিয়েছি হারিয়ে/দেখি, আমার অন্ধকূপ উঠেছে কেঁপে, শৃঙ্খল পড়েছে খসে।’
এই দেশ স্বাধীনতার একশো বছর পালন করছে। একশো বছর তো নামমাত্র সময়। মুক্তি তত দিন নেই, যত দিন না আমরা সকলে মুক্ত। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন, জেমস। ইতি তোমার জেঠু, জেমস।’’
জেমস বল্ডউইনের দেশে এখন পাতা ঝরার সময়। আর কিছু দিনে সমস্ত খাঁ খাঁ করবে। তার পর আবার জাগবে প্রতিটি গাছ, খেলবে তার রঙের খেলা। সে রং বিভাজনের নয়, একাকার হওয়ার।
বাংলা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান