যাহাকে নয়নের মণির ন্যায় যত্ন করিতে হয়, তাহাকেই সম্ভবত সর্বাধিক অবহেলা করে এই দেশের প্রশাসন। তথৈবচ রাজনীতির কারবারিরাও। জনতাকেও সচেতন বলিয়া বদনাম দেওয়া যাইবে না। সরকারি হিসাব বলিতেছে, গত বৎসর ডিসেম্বর হইতে এখনও অবধি রাজস্থানের কোটা শহরের জে কে লোন চিকিৎসালয়ে ১০২ জন শিশুর মৃত্যু হইয়াছে। যথারীতি, ইহার পরেও প্রশাসন বা রাজনীতির নেতাদের হেলদোল নাই। কংগ্রেস শাসিত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াইয়াছে বিজেপি। অপর পক্ষে, বিষয়টির রাজনীতিকরণ সমীচীন নহে বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত। তবে দুইটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এক, শিশুমৃত্যু লইয়া বিজেপি যাহা করিতেছে, তাহাকে সুবিধাবাদ বলে, রাজনীতি নহে। এবং দুই, বিষয়টি রাজনীতির অন্তর্গত হয় নাই বলিয়াই আজও তাহা এত দূর অবহেলিত। শিশুমৃত্যু বিষয়টি যতখানি ভয়ানক, সেই পরিমাণ গুরুত্ব দিতে হইলে উহাকে বৃহৎ রাজনীতির পরিসরে তুলিয়া আনিতে হয়। তাহার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা, এবং নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন।
দুর্ভাগ্যের কথা, কোটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নহে। ডিসেম্বর মাসের হিসাব ঘাঁটিলে দেখা যাইবে, গুজরাতের রাজকোট ও আমদাবাদ শহর মিলাইয়া সংখ্যাটি কোটার দ্বিগুণেরও অধিক— দুই শহরে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ২১৯। স্মরণে আসিতে পারে গোরক্ষপুরের কথা। ২০১৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তারিখে জানা গিয়াছিল, রাজ্য সরকার পরিচালিত বিআরডি মেডিক্যাল কলেজে কেবল সেই বৎসরেই ১৩১৭ জন শিশুর মৃত্যু হইয়াছে। এই রূপ অভিযোগে কলিকাতার বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালও বারংবার উত্তপ্ত হইয়া উঠে। জমানা পাল্টাইলেও এই বিষয়টিতে রাজ্য একেবারে স্থাণু। ইহার কারণ কী? সংবাদে প্রকাশ, জে কে লোন চিকিৎসালয়টি কোটা বিভাগের একমাত্র সরকারি রেফারেল হাসপাতাল হইবার ফলে বিস্তীর্ণ এলাকার যাবতীয় কঠিন সঙ্কট মোকাবিলার দায়িত্ব তাহাদের উপর আসিয়া পড়ে। কিন্তু সরঞ্জামের অপ্রতুলতা, নার্সদের সংখ্যাল্পতা এবং হাসপাতাল কর্মীদের গয়ংগচ্ছ মনোভাবও এই ভয়ানক দুর্ঘটনার পশ্চাতে দায়ী বলিয়া চিহ্নিত করা গিয়াছে। বস্তুত, প্রত্যেক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের তরফে এই সঙ্কটগুলির কথা উঠিয়া আসে।
ইহার পরেও পরিস্থিতি বদলায় না, কেননা জনতা যেন ইহাকে ভবিতব্য বলিয়াই ধরিয়া লইয়াছে। ভারতে শিশু চিকিৎসার দুর্দশার পরেও যথেষ্ট ক্রোধ বা ক্ষোভ সৃষ্টি না হইবার কারণ বহুলাংশে অজ্ঞতা। স্বল্পশিক্ষিত পরিবারের সদস্যেরা বিপদ বুঝিতে পারেন না, পারিলেও দৈব-যুক্তিক্রম সাজাইয়া লন। প্রয়োজনীয় হইচইয়ের অভাব তো আছেই। শিশুমৃত্যুকে যত দিন না কেবল সংখ্যার পরিবর্তে পৃথক ঘটনা হিসাবে গুরুত্ব দেওয়া হইবে, তত দিন অবস্থা পাল্টাইবার আশা নাই। প্রতিটি ঘটনাকেই চূড়ান্ত গাফিলতি বলিয়া চিহ্নিত করিতে হইবে, উহার তদন্ত করিতে হইবে, ভুল করা ব্যক্তির যাতে দায় বর্তাইবে, এবং পুরা ব্যবস্থাটির নিয়মিত পর্যবেক্ষণে লোক নিয়োজিত হইবে। একমাত্র এই উদ্যোগেই জনস্বাস্থ্যকে সামনের সারিতে তুলিয়া আনা যাইতে পারে। কোটা দুর্ঘটনা হউক ঘুম ভাঙাইবার ধ্বনি।