অর্থব্যবস্থার ভিত্তি শক্তপোক্তই আছে— প্রধানমন্ত্রী জানাইয়াছেন। না জানাইলেও চলিত, কারণ ভারতীয় অর্থনীতির ‘ভিত্তি’ দুর্বল, এমন সন্দেহ এখনও কাহারও মনে নাই। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া তাঁহারা যে তাণ্ডব করিতেছেন, তাহাই যাবতীয় দুশ্চিন্তার উৎস। ২০০৮ সালের মহামন্দার ধাক্কাতেও যে অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গ হয় নাই, গোটা দুনিয়া যে দেশের অর্থনৈতিক উত্থান লইয়া উচ্ছ্বসিত ছিল ২০১২-১৩ সাল অবধি, মাত্র সাড়ে পাঁচ বৎসরে তাহাকে এমন পাড়িয়া ফেলা কম কৃতিত্বের কথা নহে। তাঁহাদের হাতে এখনও নিদেনপক্ষে সাড়ে চার বৎসর সময়। অতএব, তাঁহারা আরও কী করিবেন, এবং করিবেন না, উদ্বেগের কারণ সেই অনিশ্চয়তা। বিশ্বব্যাঙ্কের ভবিষ্যদ্বাণী বলিতেছে, উদ্বেগের কারণ যথেষ্ট। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষেও ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির হার বড় জোর ৬.১ শতাংশে পৌঁছাইবে বলিয়া তাহাদের অনুমান। পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থব্যবস্থা হইয়া উঠিবার দিবাস্বপ্নের কথা এই বার প্রধানমন্ত্রীও ভুলিতে পারেন। বস্তুত, এই ৬.১ শতাংশ বৃদ্ধিও কি আদৌ সম্ভব? বিশ্বব্যাঙ্কের পুরাতন হিসাব দেখিলে ভরসা করিতে সাহস হয় না। ব্যাঙ্কের অনুমান ছিল, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার হইবে সাড়ে সাত শতাংশ। তাহাকে সটান আড়াই দশমিক-বিন্দু নামাইয়া আনিতে সক্ষম হইয়াছেন নরেন্দ্র মোদীরা। যে ভঙ্গিতে তাঁহারা দেশ চালাইতেছেন, তাহাতে আশঙ্কা হয়, আগামী দুই তিন বৎসর তুমুল সামাজিক অস্থিরতাই ভারতের ভবিতব্য। সেই অস্থিরতা অর্থনীতির পক্ষে প্রাণঘাতী। ফলে, ৬.১ শতাংশ হারে বৃদ্ধির সম্ভাবনাও ক্রমে অলীক হইতে পারে। এবং, আরও তিন বৎসর পরে অর্থনীতির ভিত্তিটিও ততখানি মজবুত থাকিবে কি না, সন্দেহ।
এই অবস্থার জন্য তিনি কাহাকে দোষ দিবেন? জওহরলাল নেহরুকে যদিও দোষী সাব্যস্ত করিতে পারেন, মনমোহন সিংহকে দায় দেওয়া চলিবে না। যে শক্তপোক্ত ভিত্তি তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছিলেন, তাহা স্বয়ম্ভু নহে। দশ বৎসর ধরিয়া সেই ভিত্তি নির্মাণ করিয়াছিলেন মনমোহন, তাহার রক্ষণাবেক্ষণ করিয়াছিলেন। বিশ্বব্যাপী মহামন্দাও সেই ভিত্তিতে ফাটল ধরাইতে পারে নাই। মনমোহন সিংহ কেন পারিলেন, এবং নরেন্দ্র মোদী কেন পারিলেন না, সেই প্রশ্নের বহুবিধ উত্তর সম্ভব। প্রথম জন অর্থনীতিকে রাজনীতির আখড়া বানান নাই, দ্বিতীয় জন বানাইয়াছেন, ইহা একটি উত্তর। মোদী ভারতীয় অর্থব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্রে নোটবন্দি ও জিএসটি নামক দুই মহাবিস্ফোরণ ঘটাইয়াছেন, মনমোহন সিংহ যাহার তুল্য কেলেঙ্কারির কথা সম্ভবত কল্পনাও করেন নাই— ইহাও একটি উত্তর। কিন্তু, সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ উত্তরটি সম্ভবত ইহা যে মনমোহন সিংহ অর্থশাস্ত্রী ছিলেন; এবং অর্থশাস্ত্রে নরেন্দ্র মোদীর দখল প্রজ্ঞা ঠাকুরের গাঁধীভক্তির তুল্য। তাহাতে ক্ষতি ছিল না— প্রধানমন্ত্রী হইতে গেলে আগে কেমব্রিজ হইতে অর্থনীতির ডিগ্রি আনিতে হইবে, এমন বাধ্যতা নাই। নেহরু হইতে নরসিংহ রাও বা বাজপেয়ী, কেহই অর্থশাস্ত্রী ছিলেন না। কিন্তু, তাঁহারা কী জানেন না, সেটুকু অন্তত তাঁহারা জানিতেন। ফলে, অর্থব্যবস্থা পরিচালনার ভারটি তাঁহারা বিশেষজ্ঞদের হাতে ছাড়িয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর ছাড়াছাড়িতে বিশ্বাস নাই। যে কয় জন অর্থশাস্ত্রী তাঁহার জমানাতেও ছিলেন, প্রত্যেকেই পলাইয়া বাঁচিয়াছেন। নীতি আয়োগের প্রাক্-বাজেট বৈঠকে অর্থমন্ত্রীর অনুপস্থিতি প্রকৃত প্রস্তাবে প্রতীকী। অর্থমন্ত্রী নিমিত্তমাত্র, দেশের অর্থব্যবস্থা চলে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার কতিপয় বিশ্বস্ত অনুচরের অঙ্গুলিনির্দেশে। রঘুরাম রাজন রাখঢাক না করিয়াই কথাটি বলিয়াছেন। ডিঙি চালাইবার যোগ্যতা যাঁহাদের নাই, তাঁহাদের হাতে জাহাজের ভার পড়িলে যাহা হওয়ার কথা, ভারতে তাহাই হইতেছে। ভিত্তির জোরে আর কত দিন? যত দিন, তত দিন।