রোহিঙ্গা নামক সংকটটি উত্তরোত্তর তীব্র হইয়া উঠিতেছে। এই সংকটের একটি দিক অবশ্যই প্রচুর সংখ্যক উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনের প্রশ্ন। ভারতে বসবাসকারী বিরাট সংখ্যক রোহিঙ্গারা শেষ পর্যন্ত ভারতীয় অধিবাসীর অধিকারেরই দাবিদার হইয়া উঠিবে, তাহা প্রত্যাশিত, হয়তো অনিবার্য। রোহিঙ্গারা যেহেতু সর্বার্থেই দেশহীন, সেই আশঙ্কাও সমধিক। প্রশ্ন: এত সংখ্যক নূতন অধিবাসীর চাপ লইবার জায়গায় কি ভারত আছে? গুরুতর প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নটি মূলত অর্থনৈতিক-সামাজিক সংগতির। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার প্রশ্নটিকে যে ভাবে নিরাপত্তার প্যাঁচ দিয়া একটি জঙ্গিদমনের প্রতিজ্ঞায় পরিণত করিতেছে, আদালতের হলফনামা হইতে প্রচারকার্য সবই যে সুরে বাঁধিতেছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাইবার উদ্যোগে ব্যস্ত হইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক তৎপরতা। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনও জঙ্গি সংযোগ আছে কি না, তাহা এখনও নিশ্চিত রূপে প্রমাণিত নয়। কিন্তু যদি কিছু রোহিঙ্গার মধ্যে সেই সংযোগ থাকিয়াও থাকে, তাহাতে নারীশিশুনির্বিশেষে সকল রোহিঙ্গাই জঙ্গি হইয়া যায় না। গোটা ভাবনাটিতে তথা সরকারি পদক্ষেপে, এখন আগাগোড়া মোদীতন্ত্রের স্পষ্ট চিহ্ন।
রোহিঙ্গা সংকটের অন্য দিকটিও বিষম জটিল: দুই অতি নিকট অথচ দ্বন্দ্বাক্রান্ত প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রক্ষার তাগিদ। মায়ানমার ও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রশ্নে আপাতত পরস্পরের বিপরীত অবস্থানে। মায়ানমারে গিয়া যে ভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদী জুন্টা ও সু চি উভয়েরই পিঠ চাপড়াইয়া দিয়া আসিলেন, তাহাতে মায়ানমার এখনও অবধি পরমপ্রীত, কিন্তু ঢাকার বিষয়টিকে ভাল ভাবে লইবার কারণ নাই। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী লইয়া বন্যাকবলিত বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থে হিমশিম খাইতেছে, চট্টগ্রাম অঞ্চল কেন, গোটা বাংলাদেশ জুড়িয়াই সাত-আট লক্ষ নূতন উদ্বাস্তুকে থাকিতে দিবার স্থানসংকুলান প্রায় অসম্ভব। তবু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মায়ানমারেরই পাশে দাঁড়াইলেন, বাংলাদেশের নয়। ভারতের অবস্থান সে দেশে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সমস্যা বাড়াইয়াছে। তাঁহার বিরোধীদের যুক্তিটি সহজ, যে প্রতিবেশী ভারতকে খুশি করিবার জন্য হাসিনার এত ‘বাড়াবাড়ি’, সে দেশ তো বিপদের দিনে বাংলাদেশি বন্ধুতার ধারও ধারে না! আসন্ন নির্বাচনী পালায় যদি শেখ হাসিনা না জিতিতে পারেন, তাহা হইলে যে জঙ্গিপনা ঠেকাইবার অজুহাতে ভারত রোহিঙ্গা-বিরোধী নীতি অনুসরণে ব্যগ্র, সেই জঙ্গি কর্মযজ্ঞ নূতন মাত্রা অর্জন করিতে পারে, মোদী ও তাঁহার কূটনৈতিক উপদেষ্টারা কি তাহা ভাবিয়া দেখিয়াছেন?
এই মুহূর্তে দরকার ছিল রাজনীতি নয়, কূটনীতি। রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্বাস্তু কনভেনশন (১৯৫১) বা প্রোটোকল-এ (১৯৬৭) স্বাক্ষরকারী না হইয়াও ভারত এ পর্যন্ত নানা শরণার্থী সংকটে কিছুটা কূটনৈতিক নীরবতার আশ্রয় লইয়াই সংকট পার হইয়াছে। দরকার ছিল সেই সুনির্বাচিত নীরবতার অনুশীলন। ভারতে ইতিমধ্যে যে রোহিঙ্গারা বসবাস করিতে শুরু করিয়াছে, নূতন ধারায় রোহিঙ্গা-শরণার্থী প্রবাহ বহিবার মুহূর্তটিকে বাছিয়া লইয়া আইন-আদালতের মাধ্যমে তাহাদের বিতাড়নের জন্য উঠিয়া-পড়িয়া না লাগিয়া দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করিয়া চলা। বস্তুত, বাংলাদেশের সহিত হাত মিলাইয়া মায়ানমারকে পরোক্ষ চাপ দিবার অবকাশ আছে কি না, তাহা বিবেচনা করা। মায়ানমার সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করিয়াও কী ভাবে এই চাপ দেওয়া সম্ভব, ঘাড়ের কাছে প্রবল পরাক্রান্ত চিন নিঃশ্বাস ফেলিতেছে জানিয়াও কী ভাবে প্রতিবেশী দেশের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া সম্ভব, এই সব বিবেচনার নামই কূটনীতি। এই মুহূর্তে দিল্লির পরিবেশে যাহার ঐকান্তিক অভাব।