শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্য়ায়
নাটকের এটি তৃতীয় অঙ্ক। প্রথমে প্রেম, মধ্যপর্বে মিলন, এখন বিচ্ছেদের বচন! নেপথ্যে রাজনীতির আবহ। শোভন চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেপিতে যোগদান এবং দিন পনেরোর মধ্যেই সেই নতুন সম্পর্ক ছিন্ন করার বাসনাকে সংক্ষেপে এই ভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। নাটকের কেন্দ্রীয় নারী-চরিত্রে এক জনই। তিনি বৈশাখী।
সবাই জানেন, শোভন যখন তাঁর পুরনো দলের থেকে দূরে সরে যান, তার অনেক আগে থেকেই তাঁর জীবনে বান্ধবী বৈশাখী প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর তৃণমূল ত্যাগের নেপথ্যে বৈশাখীর ঘোর ছায়াপাত ছিল। একই ভাবে বিজেপির প্রতি শোভনের অনুরাগ তৈরি হওয়ার পিছনেও বৈশাখীর অবদান ছিল ষোলো আনা। তাঁরই উদ্যোগে শোভন অবশেষে বিজেপিতে নাম লেখান। আবার দ্রুত সেখান থেকে নাম কাটানোর কথাও ভাবেন তাঁর এই বান্ধবীর পরামর্শ মেনেই।
কে কাকে কখন এবং কেন নিজের জীবন-নির্ভর বলে মনে করবেন, সেটা একান্তই তাঁর বা তাঁদের যুগলের ব্যাপার। এ নিয়ে কেউ শোভনের সমালোচনা করতে পারেন, কেউ মুচকি হাসতে পারেন। চাইলে বড়জোর শোভনের ‘বন্ধু-ভাগ্য’কে ঈর্ষাও করতে পারেন! তার বেশি কিছু নয়। অতএব সে আলোচনা থাক।
কিন্তু রাজনীতির মূল মঞ্চে বৈশাখী কে, কী এবং কেন— এই প্রশ্ন বোধ হয় একেবারে অবান্তর হবে না। বিশেষত শোভনের মতো অভিজ্ঞ এবং গুরুত্বপূর্ণ এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তির পদক্ষেপ যদি সর্বদা বৈশাখীর ইচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া, মান-অপমানের সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে, বিষয়টি তখন খুব চোখে লাগে। অবাকও করে।
আরও একটি কঠিন সত্য হল, তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ভাবনা— সব ক্ষেত্রেই শোভনের হারানোর পাল্লা বেশি ভারী। কারণ তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ওজন আছে। বৈশাখীর নেই। আজ পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে কি শোভনকে আম ও ছালা দুটোই খোয়াতে হবে?
তিনি বিজেপিতে যাওয়ার সময় অনেকে বলেছিলেন, নারদ কাণ্ডের সিবিআই তদন্ত এড়াতেই শোভনের এই কুশলী সিদ্ধান্ত। কিন্তু সিবিআই শোভনকে ছাড়েনি। তাঁকে বার বার ডাকা হচ্ছে। বিজেপিও বলে দিয়েছে, তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দল তাঁকে রাখবে না। এই টলমল অবস্থা তাঁর পদ্ম শিবির ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়ার মূল কারণ কি না, সেই প্রশ্ন এড়ানোর নয়।
অপর দিকে যদি তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তখন অন্য দলেও যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কট তৈরি হতে পারে, সেটাও তো অস্বীকার করা যাবে না।
তর্কের খাতিরে ধরা যাক, তিনি তৃণমূলেই ফিরে গেলেন। এ বার অভিযোগ প্রমাণিত হলে কী বলবে ওই দল? শোভন তৃণমূলে থেকে গেলে দলের পক্ষে যে ভাবে বিষয়টির রাজনৈতিক মোকাবিলা সম্ভব হত, তিনি বিজেপির ঘর ঘুরে আসার পরে তা করা কি খুব সহজ হবে? শোভনকে বিজেপি বস্তুত সেই পাকে জড়িয়ে দিল! পুরনো দলে শোভনের রাজনৈতিক রেখচিত্র যে ভাবে ঊর্ধ্বমুখী ছিল, তাতে একে ভাগ্যের পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যায়!
তৃণমূলে থাকাকালীন শোভন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কতটা কাছের মানুষ ছিলেন, সেই আলোচনা বহুচর্চিত। কিন্তু তার বাইরেও ছাত্র-রাজনীতি দিয়ে শুরু করে শোভন যে ভাবে ধাপে ধাপে মেয়র, মন্ত্রী পর্যন্ত উঠে এসেছেন, সেটা তাঁর নিজস্ব অর্জন। সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাও তাঁর কিছু কম নয়। মার খেয়ে, মার দিয়ে রাস্তায় নেমে পার্টি করেছেন তিনি। প্রথমে কংগ্রেস, সেখান থেকে তৃণমূল। ১৯৮৫-তে কংগ্রেসের কাউন্সিলর হয়ে প্রথম জন-প্রতিনিধিত্বে অভিষেক তাঁর। সেই থেকে গত বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত কখনও কোনও ভোটে তিনি হারেননি। মমতা নিজেই অনেক সময় মজা করে বলেন, ‘‘আমিও একবার ১৯৮৯-তে হেরেছিলাম। কাননের জেতার রেকর্ড আমার চেয়ে ভাল!’’
তাঁর এখনকার সবচেয়ে ‘নির্ভরযোগ্য’ বান্ধবী বৈশাখী এক জন কলেজ শিক্ষিকা। বর্তমানে একটি কলেজের টিচার-ইন-চার্জ। তাঁর শিক্ষা, বোধবুদ্ধি, সচেতনতা ইত্যাদি অন্য অনেকের তুলনায় উচ্চমানের হবে, সেটা স্বাভাবিক। তিনি নিজেও কথায় কথায় সেই অহমিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু যতটুকু জানি, তৃণমূলের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠনের বাইরে মূল দলে কোনওদিন তাঁর বিশেষ কোনও সক্রিয়তা নজরে পড়েনি। শিক্ষক সংগঠনে নেতৃত্বের সুবাদেই শাসক দলের উঁচু তলায় অনেক নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বাড়ে। শোভনের সঙ্গে অধিক ঘনিষ্ঠতা অবশ্য বছর তিনেকের বেশি বলে মনে হয় না।
এই পর্যায়ে শোভনের ব্যক্তিগত জীবনে বৈশাখীর প্রভাব এবং তাকে কেন্দ্র করে আরও যা যা ঘটেছে, এক জন রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত জীবন এবং সামাজিক জীবনকে শোভন যে ভাবে একাকার করে ফেলেছেন, তার উচিত-অনুচিত, ভাল-মন্দ তর্কসাপেক্ষ। সে সবের মধ্যে যাব না। কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞা? সেখানেও কি অভিজ্ঞ শোভনকে আড়াল করে দিচ্ছে বৈশাখীর ছায়া? মনে হচ্ছে তাঁর কলেজ-শিক্ষিকা বান্ধবী যেমন চালাচ্ছেন, ছাত্রের মতো শোভন কার্যত তেমন চলছেন!
মুখে বৈশাখী বলে থাকেন, ‘‘শোভনদাকে রাজনীতি শেখানোর ধৃষ্টতা আমার নেই।’’ অথচ, শোভনের বিজেপিতে যাওয়ার তিনিই নাকি ছিলেন সেতু! কথাটি খুব ভুলও নয়। শোভন নিজেই বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, কথাবার্তা সব বৈশাখীই চালিয়েছেন! এমনকি বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের ফোন নম্বরটিও যে শুধু বৈশাখীর কাছে ছিল, তা-ও অকপটে কবুল করেন শোভন।
এমনকি বিজেপি ছেড়ে আসতে চাওয়ার কথা বলার জন্যও শোভনের বদলে আসরে সেই বৈশাখী। শোভন কী বলতে চান, তা বকলমে শুনতে হচ্ছে বৈশাখীর মুখে। আরও জানা যাচ্ছে, তৃণমূলের মতো বিজেপিতেও বৈশাখীর ‘মর্যাদা’ ক্ষুণ্ণ হওয়ার ক্ষোভ শোভনকে তাঁর জীবনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রভাবিত, বা বলা ভাল, প্ররোচিত করছে।
কিন্তু রাজনীতিতে শোভনের অবস্থান, প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ইত্যাদি তো বৈশাখীর মাপকাঠিতে বিচার করলে চলবে না। তাই সংশয় জাগে, এ ভাবে শোভন কি দাবার ঘুঁটি হয়ে যাচ্ছেন? নিজের রাজনৈতিক পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার মানসিক স্থিতিতেও কি তিনি নেই?
শুনেছি, তৃণমূলের প্রতি বিরূপ শোভনকে ‘রাজনৈতিক সন্ন্যাস’-এর পথ থেকে নাকি ফিরিয়ে এনেছেন তাঁর এই বান্ধবী। তিনি নাকি শোভনকে বুঝিয়েছেন, রাজনীতির অঙ্গনই শোভনের স্বচ্ছন্দ ক্ষেত্র। যদি এটা তিনি করে থাকেন, তা হলে উপযুক্ত বন্ধুকৃত্যই করেছেন। অথচ বাস্তবে তাঁর অঙ্গুলিহেলনে চলতে চলতে রাজনীতির ময়দানে শোভন আজ যেখানে এসে দাঁড়ালেন, সেটা তাঁর যোগ্য প্রাপ্তি হতে পারে না।
এই লেখার সময় পর্যন্ত যা খবর, তাতে শোভনের বিজেপিতে থেকে যাওয়ার প্রশ্নে ধোঁয়াশা কাটেনি। তিনি বিজেপিতেই থেকে যাবেন, না কি অন্য পথে হাঁটবেন, সেটা পরের কথা। তবে যা-ই ঘটুক, তা এত দিনের প্রতিষ্ঠিত নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সম্মানের পক্ষে অশোভন। তিনি নিজেকে তেমনই একটি পরিস্থিতির শিকার করে তুললেন।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এ বার হয়তো সত্যিই তাঁর ‘সন্ন্যাস’ নেওয়ার সময় আসন্ন!