কল্প-গুরু? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতি, শিল্পী জি পপলাভস্কি।
নরেন্দ্র মোদী মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রনাথের কোটেশন দিয়ে থাকেন। ইদানীং সে-অভ্যেস একটু বেড়েছে, দুষ্টু লোকে বলে পশ্চিমবঙ্গে ভোট আসছে বলে। দুষ্টু লোকের কথায় কান দিতে নেই। তা ছাড়া, কথাটা সত্যি হলেই বা কী? পরীক্ষা সামনে এলে ছেলেমেয়েরা সিলেবাসে মন দেবে, স্বাভাবিক। এবং ভোটের তাড়নায় দু’ছত্র রবীন্দ্রনাথ পড়লে— নিজে না পড়লেও অন্তত পারিষদ বা মুনশিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করলে— লাভ বই লোকসান কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজন মাফিক কোটেশন বেছে নেওয়া হবে, এতেও আপত্তির কারণ থাকতে পারে না। নির্বাচনী জনসভা থেকে বাজেট বক্তৃতা— রাজনীতির নায়কনায়িকারা যে সব উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন সেগুলি সর্বদাই ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, মোদীকে অপছন্দ করি বলে তাঁকে এই কারণে আলাদা করে সুবিধেবাদী বা ধান্দাবাজ বললে ধর্মে সইবে কেন।
প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের দফা রফা হচ্ছে কি না। এই যেমন, কিছু দিন আগে একটি বণিকসভার সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, আত্মনির্ভর ভারতের জন্য চাই আত্মবিশ্বাসী ভারতীয়। এমন আশ্চর্য প্রজ্ঞার বচন শুনে সভাসদ ও শ্রোতারা নিশ্চয়ই মুগ্ধও হয়েছিলেন। এই অবধি কোনও গোল ছিল না। কিন্তু তার পরেই হঠাৎ তিনি ‘গুরুবর ট্যাগোর’-এর ‘নূতন যুগের ভোর কবিতা থেকে’ চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী ইত্যাদি আবৃত্তি শুরু করলেন। শুনে রবীন্দ্রনাথের জন্যে খুব মায়া হয়েছিল। না, বিচিত্র উচ্চারণের কারণে নয়, মায়া হয়েছিল এই ভেবে যে, শেষ কালে তাঁর অমন গানখানি মেক ইন ইন্ডিয়া-র স্লোগান হয়ে গেল!
সপ্তাহ দুয়েক আগে মন কি বাত-এর ৬৮তম এপিসোডে প্রধানমন্ত্রী আবার গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছেন। এ বারেও তাড়নাটা মেক ইন ইন্ডিয়ার। তিনি চান, দেশের ছেলেমেয়েরা বিদেশি খেলনা ফেলে স্বদেশি খেলনা হাতে তুলে নিক। তিনি আরও চান, ভারত বিশ্ববাজারে খেলনা রফতানির একটা বড় কেন্দ্র হয়ে উঠুক। তা নাহয় হল, কিন্তু গুরুদেব? সেটাই ব্রেকিং নিউজ়। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ খেলনা বিষয়ে এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যা এই বিষয়ে তাঁর চিন্তন এবং মন্থনে প্রেরণা দিয়েছে। শুনেই বেশ গা ছমছম করে উঠল— রবীন্দ্রনাথ কি তবে অচিরেই আত্মনির্ভর ভারতের আইকন হতে চলেছেন?
তবে এ বারের বিষয়টি, মানতেই হবে, বেশ নতুন ধরনের। শুনেই জানতে ইচ্ছে করল, খেলনা নিয়ে ঠিক কী বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ? এমন কৌতূহল জাগিয়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাতে ভুলিনি, নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ দেওয়ার পবিত্র সুযোগ তো আর রোজ রোজ মেলে না। সেই পুণ্য অর্জন করে কৌতূহল নিরসনে বসা গেল। এবং জানা গেল, রবীন্দ্রনাথ কথাগুলি বলেছিলেন ১৯৩০ সালে ম্যাঞ্চেস্টারে প্রদত্ত হিবার্ট লেকচার-এ। সেই বক্তৃতা এবং আরও কিছু লেখার পরিমার্জিত রূপ নিয়ে তৈরি দ্য রিলিজন অব ম্যান (১৯৩১) বইয়ের ‘ম্যান’স নেচার’ নামক অধ্যায়ে আছে তাঁর খেলনার বৃত্তান্ত। সেখানে লিখছেন তিনি, ছেলেবেলায় টুকিটাকি নানান জিনিস দিয়ে নিজের খেলনা বানিয়ে নেওয়ার স্বাধীনতা ছিল তাঁদের, অবকাশ ছিল কল্পনায় রকমারি খেলা ভেবে নেওয়ার। এই কথাটির পরেই তিনি বলছেন, “আমার আনন্দে আমার খেলার সঙ্গীদের সম্পূর্ণ অংশ ছিল, বস্তুত তারা সে খেলায় যোগ দিলে তবেই আমি সে খেলা সম্পূর্ণ উপভোগ করতে পারতাম।” এ তো, জানিই আমরা, রবীন্দ্রনাথের প্রাণের কথা। অনিবার্য ভাবে মনে পড়ে যায় ঋণশোধ তথা শারদোৎসব-এর সেই দৃশ্য। তরুণ উপনন্দ লক্ষেশ্বরের কাছে রেখে যাওয়া তার প্রভুর ঋণ শোধ করার দায়ে পাতার পর পাতা পুঁথি নকল করছে, দেখে শারদ উৎসবের আনন্দ করতে বেরনো ছেলের দল আর ঠাকুরদা আর সন্ন্যাসী সব্বাই তার চার পাশে বসে গেল তার কাজ ভাগ করে নিতে, তাকে সঙ্গে না নিতে পারলে আনন্দ সম্পূর্ণ হবে কী করে? সে-কথাই বলে ওঠে একটি বালক: “আজ লেখা শেষ করে দিয়ে তবে উপনন্দকে নিয়ে নৌকো-বাচ করতে যাব। বেশ মজা!” আর তার পরে সন্ন্যাসী গান ধরেন, ‘আনন্দেরই সাগর থেকে এসেছে আজ বান।’ যত বার পড়ি, আজও চোখে জল আসে।
ফিরে যাওয়া যাক বালক রবীন্দ্রনাথের গল্পে। এক দিন হল কী, নিজের মতো করে খেলা এবং খেলনা বানিয়ে সবাই মিলে আনন্দ করার অমল শৈশবের মধ্যে ‘বড়দের বাজারি দুনিয়া থেকে একটি প্রলোভন’ এসে পড়ল— খেলার সাথিদের এক জন নিয়ে এল একটি নতুন খেলনা। বিলিতি দোকানে কেনা, খুব দামি, একেবারে নিখুঁত সেই খেলনাটি অতঃপর তার মালিকের নিজেকে জাহির করার প্রকরণ হয়ে উঠল, এবং খেলার আনন্দ মরে গেল। সেই ছেলেবেলার খেলনা-গর্বিত সঙ্গী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমি নিশ্চিত যে, ইতিহাসের আধুনিক ভাষায় কথা বলতে জানলে সে বলত, ওই বেয়াড়া রকমের নিখুঁত খেলনাটির অধিকারী বলেই সে আমাদের থেকে সিভিলাইজ়ড— সভ্যতার দৌড়ে এগিয়ে।” সে ভাবল না, কারণ তাকে ভাবতে শেখানো হয়নি যে, ওই খেলনার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হল শিশুর নিজস্ব ধর্ম, যে শিশু প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বাস করে। “ওই খেলনায় কেবল (সেই বালকের) ঐশ্বর্যের প্রকাশ ঘটেছে, সে নিজে প্রকাশিত হয়নি, প্রকাশিত হয়নি শিশুর সৃষ্টিশীলতা, খেলার মধ্যে খুঁজে পাওয়া তার উদার আনন্দ, খেলার সাথিদের সঙ্গে তার একাত্মতার বোধ।”
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে অপরের সঙ্গে, বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ সাধনের নিরন্তর সাধনাই যাঁর কাছে মানবধর্মের প্রথম এবং প্রধান কথা, ‘বড়দের বাজারি দুনিয়া’ সম্পর্কে তাঁর মন কি বাত উপলব্ধি করার ক্ষমতা যদি নরেন্দ্র মোদীর না থাকে, তাতে অবাক হওয়ার কিছুমাত্র কারণ নেই। কিন্তু তিনি যে ভাবে গুরুদেব ট্যাগোরকে স্বদেশি বনাম বিদেশি পণ্যের খোপে ভরে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন, কিংবা রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ খেলনার চেয়ে অসম্পূর্ণ খেলনা পছন্দ করতেন বলে প্রচারে তৎপর হয়েছেন, সেটা কেবল বিরক্তিকর নয়, চিন্তার বিষয়ও বটে। তার কারণ— এই দেশটা, দুনিয়ার অনেক দেশের মতোই, এখন এমনই দাঁড়িয়েছে যে, বহু লোক, এমনকি বহু বাঙালিও নরেন্দ্র মোদীর কথামৃত শুনে রবীন্দ্রনাথকে জানতে প্রস্তুত, বস্তুত আগ্রহী। তাঁরা জানবেন না, জানতে চাইবেনও না যে, বাজারের প্রতি রবীন্দ্রনাথের কোনও রক্ষণশীল প্রাচীনপন্থী বিরাগ ছিল না, তাঁকে আধুনিক প্রযুক্তি বা বড় শিল্পের বিরোধী বলে দাগিয়ে দিলেও মস্ত ভুল হবে, তিনি মানুষের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনকে বাজারের নিয়মে চালনা করার বিরোধী, তিনি এমন পৃথিবী চান না, যেখানে অতিকায় শিল্পবাণিজ্যের মাধ্যমে অতিকায় পুঁজির ন্যূনাংশিক মালিক শ্রমজীবী বৃহদাংশিককে শোষণ করবে। সেই মুনাফাসাধক বাজারতন্ত্র তাঁর কাছে উন্নতির পথ নয়, সভ্যতার সঙ্কট।
লাগসই উদ্ধৃতি খোঁজার গণ্ডি ছেড়ে আর দু’ছত্র এগোলেই প্রধানমন্ত্রী জানতে পারতেন, খেলনার গল্পটির পরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের আর একটি অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। এক বার তিনি গাড়িতে কলকাতা আসছিলেন। দেখা গেল, গাড়ির কলকব্জায় গোলমাল, একটু চললেই ইঞ্জিন গরম হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই গাড়ি থামিয়ে জল দিতে হয়। রুক্ষ দেশ, জল পাওয়া সহজ নয়, স্থানীয় মানুষজন অনেক কষ্ট করে তাঁদের জল এনে দিচ্ছিলেন। কিন্তু কেউ তার জন্য টাকা চাননি, দিতে গেলেও নেননি, জল দিয়ে টাকা নেওয়ার কথা তাঁরা ভাবতেও পারেন না। অবশেষে কলকাতার কাছে এসে প্রথম টাকা দিয়ে জল কিনতে হল। বোঝা গেল, আধুনিক সভ্যতার বাজারি দুনিয়ায় পৌঁছে গেছেন।
না, এ-গল্প নরেন্দ্র মোদীর জানার কোনও দরকার নেই, কারণ তা তাঁর কোনও কাজে লাগবে না। তিনি তো বিশ্বের সাত লক্ষ কোটি টাকার খেলনা শিল্পে ভারত কী করে নিজের অংশ বাড়াতে পারে তার উপায় খুঁজছিলেন। কিন্তু শিশুর নিজের হাতে তৈরি অসম্পূর্ণ খেলনা? সবাই মিলে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার খেলা? গুরুবর রবীন্দ্রনাথ? সবই মায়া।