নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের প্রতিবাদে শুক্রবার হইতে পশ্চিমবঙ্গে যাহা ঘটিতেছে, তাহা কঠোর ভাবে নিন্দনীয়। প্রতিবাদের নামে জনজীবন স্তব্ধ ও বিপর্যস্ত করিবার খেলার সহিত এই রাজ্য বিলক্ষণ পরিচিত। দুই দিনের ঘটনাক্রম সেই মাপকাঠিতেও শঙ্কাপ্রদ। যত্রতত্র অবরোধ করিয়া, ট্রেনে বাসে রাস্তাঘাটে আগুন জ্বালাইয়া, ট্রেনে পাথর ছুড়িয়া, ভাঙচুর-লুটতরাজ করিয়া কোনও প্রতিবাদ হয় না— যাহা হয়, তাহার নাম গুন্ডামি। ধ্বংসাত্মক উপদ্রব নিবারণের এবং অপরাধীদের যথাবিহিত শাস্তিবিধানের দায় রাজ্য প্রশাসন অস্বীকার করিতে পারে না। রাজ্যের শাসক দল নূতন আইনের যত বিরোধীই হউক না কেন, এবং এই আইন নৈতিকতার বিচারে যত আপত্তিকরই হউক না কেন, প্রশাসনের কাজ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। ঠিক তেমনই, কোন প্রশ্নে গুন্ডামি হইতেছে, কাহারা তাণ্ডব করিতেছে, তাহার উপর প্রশাসনের আচরণ নির্ভর করিতে পারে না। গুন্ডামি দমন করা, আইনভঙ্গকারীদের গ্রেফতার করিয়া বিচারের ব্যবস্থা করা, এবং নাগরিক শান্তি বজায় রাখা— এই মৌলিক দায়িত্বগুলি পালনে, অন্তত অশান্তির প্রথম পর্বে, প্রশাসন যথেষ্ট তৎপরতার পরিচয় দিতে পারে নাই। কোনও অবস্থাতেই এই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি চলিবে না। রাজনীতির ঘোলা জলে যাহারা মাছ ধরিতে নামে, তাহারা মূলত সমাজবিরোধী— এবং, বহু ক্ষেত্রেই তাহারা ভিন্ন কোনও স্বার্থে চালিত হয়, পরিস্থিতির সুযোগ লইয়া নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। তাহাদের চিহ্নিত করিয়া নিষ্ক্রিয় করিতে হইবে।
নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধতা করিবার যথেষ্ট কারণ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের আছে। মুসলমান ধর্মপরিচিতির মানুষদের বিশেষ ভাবে প্রতিবাদ করিবার কারণও আছে— নূতন আইনটির (এবং এনআরসি-র) অভিমুখ তাঁহাদের প্রতি অনুকূল নহে। কিন্তু, সেই বিরুদ্ধতা ও প্রতিবাদ সর্বার্থেই রাজনৈতিক। তাহার মধ্যে হিংসার, বিশৃঙ্খলার কোনও অবকাশ থাকিতে পারে না। বস্তুত, এই হিংস্র উপদ্রবের পরিণাম শেষ বিচারে আত্মঘাতী হইতে বাধ্য, সে কথাও কাণ্ডজ্ঞানই বলিয়া দেয়। এবং হিংসা কেবল অন্যায় নহে, অপ্রয়োজনীয়ও বটে। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ পথেও যে শাসকদের উপর কতখানি নৈতিক চাপ তৈরি করা যায়, ভারতের তথা বাংলার মাটিতে দাঁড়াইয়া সেই কথাটি বিস্মৃত হইলে তাহা এই দেশের তথা রাজ্যের ইতিহাসের এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অপমান। দায়িত্বটি বিশেষ করিয়া নেতৃস্থানীয়দের— রাজনৈতিক নেতাদেরও, সম্প্রদায়ের নেতাদেরও। লক্ষ করিবার বিষয়, মুসলমান সমাজ হইতে, একাধিক সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হইতে শান্তিরক্ষার আবেদন করা হইয়াছে। গোটা দেশেই। কিন্তু, তাহা যে নেহাত কথার কথা নহে, তাহাও প্রমাণ করা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রেও প্রশাসনের কাজ কম নহে। সমাজ তথা সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের সহিত ধারাবাহিক সংযোগের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে অবিচলিত থাকিবার প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝাইয়া বলা অত্যন্ত জরুরি।
রাজ্যের প্রধান প্রশাসক হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথাগুলি বলিয়াছেন তাহা সুবিবেচনার পরিচায়ক। এই কথাগুলি বলা জরুরি ছিল। কিন্তু জরুরি হইলেও, কথা যথেষ্ট নহে। অশান্তির কারবারিদের কঠোর ও নিরপেক্ষ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং শান্তির পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করার গুরুদায়িত্ব তাঁহাকে পালন করিতে হইবে। অতীত সাক্ষ্য দিবে, গোটা দেশে যখন সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বলিয়া উঠিয়াছিল, তখনও পশ্চিমবঙ্গে শান্তি বজায় ছিল, এক বার নহে, একাধিক উপলক্ষে। অর্থাৎ, সাম্প্রদায়িক (অপ)শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখিবার অন্তর্নিহিত শক্তি এই রাজ্যের সমাজে আছে। সেই শক্তিকে শান্তিরক্ষার কাজে কতটা সার্থক ভাবে ব্যবহার করা যাইবে তাহা নির্ভর করে শীর্ষ প্রশাসনের সদিচ্ছা, দক্ষতা ও তৎপরতার উপর। ইহা মুখ্যমন্ত্রীর একটি বড় পরীক্ষা। প্রশাসক হিসাবেও, রাজনীতিক হিসাবেও। নূতন আইনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের প্রকরণ হিসাবে একাধিক দিন মিছিলে হাঁটিবার যে সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রী করিয়াছেন, তাহা এই প্রেক্ষিতেই মূল্যবান। এই সঙ্কটের ক্ষণে রাজ্যের প্রত্যেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের দায়িত্বও কম নহে। শুভবুদ্ধিতে সুস্থিত থাকিবার দায়িত্ব, চিন্তায় ও বাক্যে সংযত থাকিবার দায়িত্ব। তথ্য ও মিথ্যার প্রবল এবং তাৎক্ষণিক বহুলপ্রচারের এই যুগে সেই সংযম আক্ষরিক অর্থেই জীবনমরণের প্রশ্ন। হুঁশিয়ার থাকিবার দায় আজ আর কেবল কান্ডারির নহে, প্রতিটি সুনাগরিকের।
যৎকিঞ্চিৎ
অভিজিৎ বিনায়ক ধুতি পরে নোবেল মঞ্চে উঠলেন, বাঙালিয়ানার দামামা বেজে উঠল, সকলে ধন্য ধন্য করলেন। কিন্তু এস্থার দুফলো কোন আক্কেলে শাড়ি পরলেন? নিজের দেশ ও জাতির দ্যোতক পাশ্চাত্য পোশাক না পরে, স্বামীর প্রতি সামীপ্য জ্ঞাপন? তাও এই রমরমা নারীবাদের যুগে? ফরাসিরা কত আশাহত হবেন এই পোশাকে ওঁকে দেখে? কে কী পরবেন, সে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার, তবু— বাপের বাড়িকে ত্যাগ করে সেরা মঞ্চে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ ঘোষণা!