গিরিরাজ সিংহ
সনিয়া গাঁধী
ভাষায় খুব কর্কশ ভাবে আঘাত দিয়ে কথা বলার প্রবণতাকে পরিহার করাকেই সৌজন্য বলে মনে করি আমরা। সে কারণেই ‘আমাদের ছেলে পরীক্ষায় ফেল করেছে’ না বলে আমরা বলি, সে ‘পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি।’ শব্দের ব্যবহারে সৌজন্য রাখতে চাই বলেই আমরা ‘ধাঙড়’ না বলে ‘জমাদার’ বলি। ‘পরিচারিকা’কে বলি ‘কাজের মেয়ে’। ইংরেজিতে এই কর্কশ ভাবকে কোমল করে নেওয়াকে বলে ইউফেমিজম। বাংলায় এই শব্দটির একটা চমত্কার প্রতিশব্দ করেছিলেন অধ্যাপক শ্যামাপ্রসাদ চক্রবর্তী। তিনি বলেছিলেন, ‘মঞ্জুভাষণ’। অধ্যাপক জ্যোতিভূষণ চাকি বাগর্থ কৌতুকি গ্রন্থে এই বিষয়টি নিয়ে এক অসাধারণ প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
প্রশ্ন হল, রাজনীতির জগতে যখন একটি দল অন্য দলকে কর্কশ ভাবে আক্রমণ করে, এক ব্যক্তি যখন অন্য ব্যক্তিকে তাঁর শব্দ প্রয়োগে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন এই মঞ্জুভাষণ কোথায় থাকে? বিহারের রাজপুত নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ ক’দিন আগে সনিয়া গাঁধী সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন, তার পর নতুন করে ফের এই বিতর্ক দানা বেঁধেছে। দু’দিন ইলেকট্রনিক চ্যানেলে হইচই হল। মন্ত্রী একটা বিবৃতি দিয়ে বলে দিলেন, কেউ যদি তাঁর মন্তব্যে আঘাত পেয়ে থাকেন, তা হলে তিনি দুঃখিত। আমরা আবার প্রাত্যহিকতায় সে সব বিস্মৃতও হলাম।
এটা শুধু ইতর শব্দ প্রয়োগের ব্যাপার নয়। অনেক সময় নিম্নবর্গের মানুষ সমাজের নিচুতলায় অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে ইতর শব্দ প্রয়োগ করে। অভিজাত শ্রেণির বৈঠকখানায় সেই কথা ব্যবহার করা যায় না। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক শব্দ ব্যবহারে আমরা সহজ হয়ে উঠছি। আগে ঘুষ কথাটা ব্যবহার করতে অস্বস্তি হত। আমরা বলতাম জলপানি, মিষ্টি খাওয়ার পয়সা, পান-তামাকের ব্যবস্থা, সেলামি। এখন আমরা স্বচ্ছন্দে ঘুষ শব্দটা ব্যবহার করতে পারি। চুরিকে বলতাম হাতটান। এমনকী, কবিতায় স্তন শব্দটির ব্যবহারে আগে তেমন আপত্তি ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ‘স্তন’ কবিতাটি চির অমর। সেটা ছিল কবিতায় মঞ্জুভাষণ। কিন্তু, এখন আমরা যৌন শব্দ প্রয়োগেও অনেক বেশি সাহসী।
আসলে শুধুই অভিজাত বা ইতর শব্দের প্রশ্ন নয়। সামাজিক শ্রেণি বিভাজনের প্রশ্নও নয়। প্রশ্নটা হল দৃষ্টিভঙ্গির। এক জন রাজনৈতিক নেতা তাঁর সতীর্থ সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এমিলি পোস্ট-এর পৃথিবী বিখ্যাত একটি বই ‘এটিকেট’। মহাভারতসম এই বইটি সহবতের বাইবেল। হোটেলের পরিচারিকা থেকে শুরু করে বিমানসেবিকা, অফিসের বৈঠক থেকে কলেজের শিক্ষকতা— সর্বত্র কী ভাবে এটিকেট রক্ষা করা যায় তার উপরে বইটিতে সবিস্তার বর্ণনা রয়েছে। সব পেশার কথা বলা হলেও এই বইটিতে কিন্তু রাজনৈতিক নেতার এটিকেট নিয়ে কিছু বলা নেই। তবে, বইটির গোড়াতে এমিলি বলেছেন, আসলে এটিকেট জিনিসটা শুধুমাত্র কী করবেন আর কী করবেন না, তার তালিকা নয়। আসলে এটা একটা জীবন দর্শন। অন্য মানুষের প্রতি সুষ্ঠু শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। যা আসলে আত্মশ্রদ্ধারও পরিচায়ক।
আলেকজান্ডার এবং পুরুর কথোপকথনে আমরা এই এটিকেট দেখেছি। পুরুরাজকে পরাস্ত করার পরেও আলেকজান্ডার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কী রকম ব্যবহার তাঁর কাছ থেকে পুরু প্রত্যাশা করেন। পুরুও কম যান না! তিনি বলেছিলেন, রাজার কাছ থেকে রাজার সম্মান আশা করি। নেহরু যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনও রাজনীতিতে নিষ্ঠুরতা ছিল। স্বার্থসিদ্ধির তাগিদ ছিল। কিন্তু, কখনওই এক জন আর এক জনের সঙ্গে ব্যক্তিগত আচরণের লক্ষণরেখা অতিক্রম করেননি। সিপিএমের সংসদীয় দলনেতা পি সুন্দরাইয়ার সঙ্গে এক বার নেহরুর কথা কাটাকাটি তীব্র হয়ে উঠেছিল। বিতর্কের বিষয় ছিল, লেডি মাউন্টব্যাটেনের ভারত আগমনের খবর। স্বাধীনতা হয়ে গিয়েছে, তা হলে আবার লেডি মাউন্টব্যাটেন কেন আসছেন? এটাই ছিল ওই সিপিএম নেতার বক্তব্য। এই ব্যক্তিগত ইঙ্গিতে নেহরু খুব রুষ্ট হয়েছিলেন। তখন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান রাধাকৃষ্ণণ। কিন্তু, পরে নেহরু তাঁর ভুল বুঝতে পারেন। সুন্দরাইয়াও দুঃখপ্রকাশ করেন। এক বিকেলে নেহরু তাঁর বাড়িতে চা-চক্রে তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন। সেই সৌজন্যের বৈঠকে তিক্ততার রেশটুকু একেবারেই মিটে যায়। সংসদে এ রকম ঘটনা অনেক হয়েছে। কিন্তু, লক্ষণরেখা সচরাচর কেউ অতিক্রম করতেন না।
আর এখন যেন নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত পোস্টার পড়েছে! ২০১৫ সালে এই সংস্কৃতি কোথায় গেল?