অসমের আর্থিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অনুপ্রবেশকারীদের

বিহারিরা জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে নতুন বাসযোগ্য জমি তৈরি, তেলের খনি থেকে তেল এবং কয়লার খনি থেকে কয়লা তুলে আনতে লাগলেন। অন্য দিকে তাঁদের পেটের ভাত যোগাতে লাগলেন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা সংখ্যালঘু কৃষক সম্প্রদায়। লিখছেন গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়এই অনুপ্রবেশকারীদের সাধারণত দু’ভাবে দেখা হয়ে থাকে। শ্রমিক হিসেবে এবং শরণার্থী হিসেবে। অনুপ্রবেশকারীদের আগমন সেখানেই ইতিবাচক হয় যেখানে দেশি শ্রমিক এবং ভিন্‌ দেশি শ্রমিকেরা অর্থনীতিতে যোগদানের সমান সুযোগ পান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৯ ০৪:০৫
Share:

অসমের এনআরসি কেন্দ্রে ভিড়। ফাইল ছবি

অনুপ্রবেশকারী ও অর্থনীতির মধ্যে সম্পর্ক খুব গভীর এবং জটিল। বস্তুত অনুপ্রবেশকারীরা শ্রম-বাজারের উপর নির্ভরশীল। সারা বিশ্বে দেখা গিয়েছে অনুপ্রবেশকারীরা শ্রম নির্ভর কার্যকলাপে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। তবে সেটা প্রধানত নির্ভর করেছে অনুপ্রবেশকারীদের কর্মদক্ষতা এবং আশ্রয়দাতা দেশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপরে। ২০১৫ সালের ‘ওইসিডি’র (অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কোয়াপরেশান অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট) একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, যেমন, জার্মানিতে ১.২ কোটি, ব্রিটেনে ৮৫ লক্ষ, ফ্রান্সে ৭৮ লক্ষ, স্পেনে ৫৯ লক্ষ, ইতালিতে ৫৮ লক্ষ, সুইডেনে ১৬ লক্ষ, অস্ট্রিয়াতে ১৫ লক্ষ, বেলজিয়ামে ১৪ লক্ষ, ডেনমার্কে ৫ লক্ষ ৭২ হাজার এবং ফিনল্যান্ডে ৩ লক্ষ ১৫ হাজার মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই অনুপ্রবেশকারীরা মূলত আসে রাশিয়া (৬০ লক্ষ), পোল্যান্ড (৩৬ লক্ষ), রোমানিয়া (৩ লক্ষ), মরক্কো (২৫ লক্ষ) প্রভৃতি দেশ থেকে। সমীক্ষাটি প্রমাণ করে অনুপ্রবেশকারীদের প্রভাব সেই দেশের পক্ষে বেশ ইতিবাচক। এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ইউরোপের ৩৪টি মধ্যবিত্ত দেশে ৬৯ ভাগ এবং ২২টি ধনী দেশের ৮৩ ভাগ জন সাধারণের উপরে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

Advertisement

এই অনুপ্রবেশকারীদের সাধারণত দু’ভাবে দেখা হয়ে থাকে। শ্রমিক হিসেবে এবং শরণার্থী হিসেবে। অনুপ্রবেশকারীদের আগমন সেখানেই ইতিবাচক হয় যেখানে দেশি শ্রমিক এবং ভিন্‌ দেশি শ্রমিকেরা অর্থনীতিতে যোগদানের সমান সুযোগ পান। তাঁরা দেশের অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হলে কোনও সমস্যা হয় না। দেখা যায়, তাতে স্থানীয় মানুষের আয়ের পথ প্রশস্ত হয়, চাকরির বাজার তৈরি হয় এবং সর্বোপরি জীবনধারার মান উন্নত হয়ে থাকে। কিন্তু যদি গতানুগতিক, ক্ষণস্থায়ী বা স্বল্পকালীন শ্রম অথবা শুধু শরণার্থী হিসেবে তাঁরা থেকে যান তবে ভবিষ্যতে প্রতিক্রিয়া বিরূপ হতে পারে। আসুন, এই আলোয় অসমকে একটু দেখে নেয়া যাক।

১৮৩৫-’৩৬ সালে ব্রিটিশেরা অসমে চা চাষ শুরু করে। প্রথম ভারতীয় চা লন্ডনে নিলাম হয়ে বিশ্ববাজারে পৌঁছল ‘আসাম টি কোম্পানি’র হাত ধরে। চা তৈরির কারখানাগুলি গজিয়ে উঠল ডিব্রুগড়, বুড়িদিহিং এবং টিংগারি নদীর উপত্যাকায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, দ্বারকানাথ ঠাকুর এই কোম্পানির অন্যতম ডাইরেক্টর ছিলেন। ধীরে ধীরে ১৮৫৮ সালে ‘জোড়হাট টি কোম্পানি’ এবং কাছাড় ও সিলেট অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র, সুরমা ভেলি এবং ডুয়ার্স অঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার মতো অজস্র চা কোম্পানি জন্ম নেয়। ১৮৫৯ সালে ৭,৬০,০০০ পাউন্ড চা উৎপাদন হয়। ১৯০৩ সালের মধ্যে, ২,৩১,৫৪৭ একর জমি চা শিল্পের আওতায় চলে আসে। এতে ব্রিটিশ সরকার ১ কোটি ৪০ লক্ষ পাউন্ড বিনিয়োগ করে। এই সময়ে অসমে ভূমিহীন কৃষক ছিল না বললেই চলে। ফলে এই বিশাল অংশের জমিতে কাজ করার স্থানীয় কোনও শ্রমিকই ছিল না। অন্য রাজ্য থেকে শ্রমিক না আনা ছাড়া কোনও উপায় থাকল না।

Advertisement

১৮৫৩ সালে প্রথম ‘আসাম টি কোম্পানি’ সাঁওতাল কর্মী আনা শুরু করে বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে। তার পরে ধীরে ধীরে উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা এবং বাংলা থেকেও লোক নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। ১৯২৩ সালে এই সব চা বাগানে বহিরাগত কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫,২৭,০০০। এই বিশাল সংখ্যক কর্মীদের খাদ্য যোগাতে চাল উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন হয়ে পড়ল। বাজারে চালের দাম বেড়ে গেল। অসমিয়া কৃষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকল বটে, তবে চালের উৎপাদন যথেষ্ট ছিল না। অসমের বিভিন্ন জেলায় ব্যবসা-বাণিজ্য রমরমিয়ে চলতে থাকল। এই বাণিজ্যিক উন্নতি ধরে রাখতে প্রয়োজন হয়ে পড়ল রেল, রাস্তা, নদীর মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা। এ দিকে পতিত জমি দখল করে নিতে থাকল ডাফলা, মিরি, এবোর, খামতি, সিংফো নামক পাহাড়ের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী। এবং পাশের পূর্ব বাংলা থেকে বিশেষ করে ময়মনসিংহ জেলা থেকে অসমের উর্বর জমিতে চাষবাস করার জন্য মানুষের ঢল নামল। শাপে বর হল। অবশেষে ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ সরকার ২,৬৩,০০০ একর জমি সরকারি ভাবে এই অনুপ্রবেশকারীদের দিল ধান চাষ করার জন্য। এর পরে এই অনুপ্রবেশকারীরা বিভিন্ন জমিদারের ভাড়াটে হিসেবে কাজ করতে শুরু করে দেয়। ১৯২১ সালের লোক গণনায় শুধুমাত্র অসমের চা বাগানে বহিরাগতর সংখ্যা ছিল ১৩,০০,০০০। যা সেই সময়ে অসমের জনসংখ্যার ৬ ভাগের ১ ভাগ ছিল।

বহিরাগতদের আসার একটি অন্যতম কারণ ছিল, ২০০ বছরের অহম শাসনকালে ভূমি-রাজস্ব বিভাগে একটি নিয়ম জারি ছিল। সেটি হল বংশ পরম্পরায় সম্পত্তির অধিকার ছিল মাত্র ‘বাড়ি’ এবং ‘বস্তি’ জমিতে (বাগান এবং বাসভবন নির্মাণের জন্য যে জমি)। ‘রুপিত মাটি’ অর্থাৎ কৃষিযোগ্য জমি কখনও কারও সম্পত্তির আওতায় পড়ত না। সব কৃষকদের অবাধ স্বাধীনতা ছিল জমি চাষ করার, জঙ্গলের কাঠ কাটার, বাড়ি তৈরি করার সামগ্রী জোগার করার, পশুচারণের এবং ধান চাষ করার (ভুঁইয়া ১৯৪৯; ৭-১১, গেইট ১৯৬৭;২৪৩-৫১)।

১৮৮৯ সালে ব্রিটিশেরা প্রথম তেলের সন্ধান পায় এবং ডিগবয়ের তেলের কুয়ো থেকে ১৪ মাস চেষ্টা করে ২০২ মিটার গভীর থেকে ১৮৯০ সালে এক লক্ষ টন অশোধিত তেল তুলতে সক্ষম হয়। ইংরেজদের মতে, এই ‘কঠিন’ কাজ কখনই সম্ভব ছিল না ভীষণ কর্মঠ বিহারিদের ছাড়া। এক দিকে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে নতুন বাসযোগ্য জমি তৈরি করা, অন্য দিকে, হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে তেলের খনি থেকে তেল এবং কয়লার খনি থেকে কয়লা তুলে আনতে লাগলেন তাঁরা। অন্য দিকে তাঁদের পেটের ভাত যোগাতে লাগলেন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা সংখ্যালঘু কৃষক সম্প্রদায়।

এ ভাবে উনবিংশ শতকের শেষভাগে দেখা যায় অসমে চা, তেল, কয়লা, সিল্ক, পাট, কাঠ বিক্রি করে অর্থনৈতিক উন্নতিতে বিশ্ববাজারকে ছুঁয়ে ফেলে এই তথাকথিত বহিরাগতদের হাত ধরে।

প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বিসি কলেজ, আসানসোল

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement