অনেক সময়ে বিষাদের দিনে রং আমাদের ভাল রাখে, রং আমাদের ভালবাসতে শেখায়; তাই তো বসন্তের প্রকৃতি যখন চারিদিকে কাগজ ফুলে মুড়ে যায়, শিমূল-পলাশে লাল আলো ছড়ায়, আমরা তখন একে ভালবাসার ঋতু বলি। কিন্তু এমন অনেক বসন্ত আসে যখন চাইলেও রক্তের আঁশটে গন্ধ, পোড়া শরীরের ক্ষত কিছুতেই ভুলে থাকা যায় না। ভুলে থাকা যায় না প্রতি বসন্তে ঝরে যাওয়া লাল ফুলের সঙ্গে একটা নাম আকাশে তারা হয়ে বেড়ে চলে...। এ সব বসন্তে যখন রং আঁকড়ে ধরতে চাই, তখন যে ছবিগুলো আঁকা হয় এগুলো এমনই বিষাদবসন্তের ছবি। — লাবণী জঙ্গি, গবেষক, আন্দোলনকারী (সঙ্গের ছবি: তাঁর ভাবনায় বর্তমান সময়ের ভারতমাতা)
‘‘জিত গায়ে তো বতন মোবারক
হার গায়ে তো কাফন মোবারক’’— এই দৃপ্ত উচ্চারণ এক নারীর। কোন সে নারী? না, সে দিল্লির শাহিন বাগে ধর্নামঞ্চে অবস্থানরত অশীতিপর বৃদ্ধা বিলকিস দাদির।
দাদির সঙ্গী অসংখ্য মা-বোনেরা গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে আজ অবধি অনেকগুলো দিন অতিক্রম করেছেন ধর্নায় বসে। রাজধানীর সেই অর্থে অখ্যাত এক জায়গা শাহিন বাগ। কিন্তু আজ শুধু দেশের প্রতিটি মানুষই নয়, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে সারা বিশ্বের কাছেই শাহিন বাগ পরিচিত হয়ে উঠেছে। দেশের নানা স্থানে যে মা-বোনেরা এনআরসি-সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পথে নেমেছেন, তার প্রেরণাও শাহিন বাগ। তাই আজ মহিলাদের ধর্না অবস্থান বোঝাতেও মানুষের মুখে মুখে ‘পার্ক সার্কাসের শাহিন বাগ’, ‘নাগপুরের শাহিন বাগ’, ‘পলাশির শাহিন বাগ’।
কিন্তু অন্তঃপুরের মহিলারা, তার চেয়েও বড় কথা, যাঁদের অধিকাংশই রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের— তাঁরা ঘরদোর, সংসারের নিত্য দিনের কাজকর্ম ফেলে এমন করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন কেন? এমন মনোবল, তেজ বা দৃঢ়তাই বা কোথা থেকে এল? তাঁরা তো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পোড়-খাওয়া নেত্রী নন! কোনও রাজনৈতিক দলের পাকা মাথার নেতাও তো তাঁদের পরিচালনা করছে না! বরং এই আন্দোলন পরিচালনায় এসেছে পদে পদে বাধা। শাহিন বাগে পুলিশ অবস্থান করতে অনুমতি দেয়নি। কিন্তু ধর্না তুলে দিতেও পারেনি। দিল্লির হাড়কাঁপানো ঠান্ডাও শাহিন বাগের মনোবলের কাছে পরাজিত। এই দৃঢ়তা ও এত মনোবল কেমন করে তাঁরা পেলেন? এর উত্তর দিয়েছেন শাহিনবাগের ‘দাদিরা’। সুপ্রিম কোর্টের মধ্যস্থতাকারী আইনজীবীদের তাঁরা বলেছেন— ‘‘আমাদের উদ্বেগ, ব্যথা বোঝার চেষ্টা কেউ করছেন না, যে উদ্বেগ, যে আশঙ্কা আমাদের ঘর থেকে এখানে বের করে এনেছে, তা সরকার বুঝতে চাইছে না।’’
আরও পড়ুন: ওরা তোমার লোক? অ মা, আমরা কার লোক তবে?
সেই ব্যথাটা কী? উদ্বেগটা কী? অসমের মতো সারা দেশে এনআরসি হলে তো কোটি কোটি মানুষের নাম বাদ গিয়ে তাঁরা ‘অ-নাগরিক’, ‘বে-ঘর’ হয়ে যাবেন। সরকার এবং সরকারি দল বিজেপি সদর্পে জানিয়েছে— তার পর তাঁদের স্থান ডিটেনশন ক্যাম্প। অবশ্য ‘ভক্ত’দের উদ্বাহু নৃত্যে রসদ জোগাতে তাদের ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা বলছেন— এদের পাঠানো হবে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে। উদ্বেগ কি হিন্দুদের হচ্ছে না? হচ্ছে। তবে তার জন্য তো বিজেপির ঝুলিতে আছে প্রতারণাপূর্ণ সিএএ। শুধু আবেদন করলেই ‘নাগরিকত্ব’। মোদী-শাহকে অভিনন্দন জানাতে এখানে সেখানে ‘অভিনন্দন যাত্রা’ও হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ হিন্দুদের মন থেকে তবুও সন্দেহ দূর হচ্ছে না, উদ্বেগের নিরসন হচ্ছে না।
আরও পড়ুন: আমার ভেতরের নারীকে গড়া আজও শেষ হয়নি
আসলে আক্রমণটা তো ভয়ঙ্কর! এই আক্রমণ তো জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, ট্যাক্স-বৃদ্ধি, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি বৃদ্ধি বা ছাঁটাই লকআউটের মতো আর্থিক আক্রমণ নয়— নিজের দেশে মানুষ স্বাধীন ভাবে থাকতে বা বসবাস করতে পারবে কি না, সেই অধিকারের উপরেই আক্রমণ। ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করার আক্রমণ। নাগরিকত্ব না থাকলে তো অন্য কোনও অধিকারই তার থাকে না। শিক্ষা, চাকরি, চিকিৎসা, ব্যবসা, সম্পত্তি— কোনও কিছুই নয়। বরং বিনা নাগরিকত্বে থাকার অপরাধে সে অপরাধী। এনআরসি করে কোটি কোটি মানুষকে সরকার এমনই দুরবস্থায় ফেলতে চায়।
অসমে ঠিক এমনটিই হয়েছে। তাই স্বাধীনতার আন্দোলন। এত দিন পর্যন্ত নাগরিক অধিকার প্রয়োগে ‘ভোট প্রদান’ করার সব চেয়ে বড় প্রমাণপত্র ছিল ভোটার তালিকায় নাম থাকা। সেই তালিকায় নাম থাকলে একটি সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। এনআরসি-সিএএ বিতর্কে বলে দেওয়া হচ্ছে, এটা নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। সরকারকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, অ-নাগরিকেরা কি ভারতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকারী? এর উত্তর সরকার দিচ্ছে না। কারণ, তা হলে যে মোদী-শাহেরা অ-নাগরিকের ভোটে নির্বাচিত বলে স্বীকার করতে হয়!
এনআরসি-তে অসফল হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, পার্শি অ-নাগরিকদের নাগরিকত্ব দিতে নাকি সিএএ আনা হয়েছে। তবে এনআরসিতে অসফল ওই সমস্ত ধর্মের অ-নাগরিক মাত্রেই নাগরিকত্ব পাবেন না। ২০১৪ সালের মধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু সেখানে একটা বৃহৎ ‘যদি’ রয়েছে। যদি আবেদনকারী তাঁর দেশে তাঁর ধর্মের উল্লেখ থাকা সরকারি নথি দেখাতে পারেন, তবেই সেই আবেদন গ্রাহ্য হবে। আর আবেদন গ্রাহ্য না হলে ‘অ-নাগরিক মুসলমান’-এর যে দশা হবে, বিজেপির এনআরসি-সিএএ দাওয়াইয়ে ‘অ-নাগরিক হিন্দু’র দশাও তা-ই হবে। এই বিষয়টা এখনও অনেকেই বুঝতে পারছেন না, প্রতারণামূলক প্রচারে।
আক্রমণটা মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের উপরে অনেক বেশি সরাসরি। যে মায়েরা-বোনেরা নিজের স্বামী, সন্তান, স্বজনকে লালনপালন করতে গিয়ে বদ্ধ ঘরের কোণে পড়ে থাকেন, তাঁরা যখন বুঝছেন সেই বদ্ধ ঘরেও হয়তো তাঁদের ঠাঁই হবে না এনআরসি-সিএএ চালু হলে— তখন তাঁদের সরাসরি রাস্তায় নামা ছাড়া আর পথ কোথায়? বিপদের রূপটা যত বেশি স্পষ্ট হবে, অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মা-বোনেদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং প্রতিরোধ তত দৃঢ় হবে।
তিন মাস হয়ে গেল সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হয়েছে। আর ক’দিন পরেই এই নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদনপত্র গ্রহণ নাকি শুরু হবে। বিজেপি বলছে, মতুয়া সম্প্রদায়ের লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুকে তারা নাগরিকত্ব দেবে। কিন্তু এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু কি নাগরিকত্ব পেতে আবেদন করবেন? সাধারণ বুদ্ধি বলছে— না। কারণ, এঁরা প্রায় সকলেই ভোটার। অন্য কথায় ‘নাগরিক’। আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রমাণ হবে আবেদনকারী ‘বিদেশি’ এবং আইন অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে ভোটার তালিকা থেকে তাঁর নামটি কাটা যাবে। যিনি চাকরি করছেন, তাঁর চাকুরিটাই বা থাকবে কী করে? কোনও নাগরিক অধিকারই তাঁর থাকবে না— যত ক্ষণ পর্যন্ত না তিনি নতুন করে ‘নাগরিকত্ব’ পান। ফলে বিপদটা হিন্দু উদ্বাস্তুদেরও বড় বেশিই।
এক দিকে এই ভয়াবহ বিপদের হাত থেকে বাঁচতে এ দেশের বিপুল সংখ্যক ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক চেতনাসম্পন্ন ও গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মানুষ এনআরসি, সিএএ, এনপিআর-এর বিরোধিতায় প্রবল ভাবে প্রতিবাদী। অন্য দিকে, কোনও রাজনৈতিক দলের মদত ছাড়াই দেশের নানা প্রান্তে শাহিন বাগ মডেলে গড়ে উঠেছে প্রতিবাদ। মফস্সল, ছোট শহর, গঞ্জ, বড় শহরে যে যেখানে পারছেন, সংগঠিত করছেন শত শত শাহিন বাগ। অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে শাহিন বাগ হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের অন্য নাম। শাহিন বাগের দাদিরা হয়ে উঠেছেন সারা দেশব্যাপী প্রতিবাদের অন্যতম মুখ। হার-না-মানা জেদ ও স্পষ্ট কণ্ঠস্বরের তীব্রতা আজ দেশকে আলোড়িত করে তুলেছে।
বোরখা-হিজাবে সাজিয়ে রাখা পুতুল, বিরিয়ানির লোভে, টাকার লোভে বসে থাকা বলে কটাক্ষ এলেও এই নারী জাগরণকে অস্বীকার করার আজ আর উপায় নেই৷ ৯০, ৮০, ৭০ বছরের বৃদ্ধা, সদ্যোজাত সন্তান কোলে যুবতী মা, সদ্য সন্তানহারা মা-ও শামিল হয়েছে ধর্নায়। তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে। শিক্ষিত-এলিট ক্লাসের ছাত্রী, যাঁদের সম্পর্কে ভাবা হয় তাঁরা সমাজ সম্পর্কে উদাসীন— তাঁরাও আজ দলে দলে এই আন্দোলনে শামিল।
কলকাতার পার্ক সার্কাস বা আসানসোল, শিলিগুড়ি, পলাশি, বহরমপুর, পাটিকাবাড়ি— সর্বত্রই মহিলাদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। এর বাইরেও রয়েছে দুই, তিন বা চার দিনের ঘোষিত অবস্থান।
ব্যতিক্রম নয় পলাশির নেতাজি সুভাষ ধর্নামঞ্চ। এখানকার বিশেষত্ব হল, প্রথম দিন মহিলাদের উপস্থিতি নামমাত্র হলেও দিন যত এগোচ্ছে, মহিলাদের উপস্থিতি বাড়ছে তাল মিলিয়ে। এঁদের কণ্ঠেও একই সুর— ‘‘এনআরসি-সিএএ বাতিল না করা পর্যন্ত অবস্থান চলবে।’’
কৃষ্ণনগরে মিছিল ও অবস্থানে বেথুয়াডহরির প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছিলেন সত্তরোর্ধ্ব সুফিয়া বিবি— একেবারে নিজের উদ্যোগে৷ জানালেন, তাঁকে কেউ খবর দেননি। তবুও এসেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। আরও আশ্চর্যের বিষয়, দিল্লির সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক আক্রমণের খবর জানার পর কৃষ্ণনগরের এক এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সংগঠককে ফোনে তাঁর পরামর্শ— ‘‘তোমরা যেন ভয় পেয়ে আন্দোলন থামিয়ে দিয়ো না। তোমাদের আন্দোলনে আমায় খবর দিয়ো।’’ এ যেন এক প্রতিবাদের নতুন মানুষ। দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন।
নারীশিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, সমানাধিকার— এ সব এখন আমাদের দেশেও পুরনো কথা। মহিলা প্রধানমন্ত্রী, মহিলা রাষ্ট্রপতি, মহিলা রাজ্যপাল, মহিলা মুখ্যমন্ত্রী বা মহিলা পাইলট, মহাকাশচারী, সেনা কমান্ডার তো আমরা পেয়েই গিয়েছি। বিদ্যাবুদ্ধিতেও মহিলারা আগের চেয়ে অনেকে এগিয়ে গিয়েছেন। সে দিক থেকে ভারতে মেয়েরা আর পিছিয়ে নেই। যদিও সময়ের নিরিখে তা নিতান্তই কম। কিন্তু এই এগিয়ে থাকাতেও মুসলিম মেয়েদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে খুবই কম। তুলনামূলক হিসাবে যেখানে এখনকার পরিস্থিতিতে যা হওয়ার কথা ১৭ শতাংশ, সেখানে মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রে তা মাত্র ৪ শতাংশ।
এর কারণ অবশ্যই আর্থিক এবং ধর্মীয় সংস্কার। সেই কারণেই সংস্কৃতি, সঙ্গীত, নৃত্যে তাঁদের অংশগ্রহণ খুবই কম। ঘরের বাইরে বেরনোও তাঁদের কাছে প্রথাবহির্ভূত। ফলে মুসলিম মহিলাদের এই যে দলে দলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া, ধর্নামঞ্চে যোগ দেওয়া— একটি নজিরবিহীন ঘটনা। যা স্বাধীনতা আন্দোলনেও দেখা যায়নি। নারীজাগরণ ব্যতীত কোনও দেশ জাগতে পারে না। তাই নবজাগরণের মনীষীরা নারীদের জাগাতে চেয়েছিলেন। শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলায় সঞ্জীবিত করে নারীজাতিকে পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন তাঁরা।
স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগের এক কবি বলেছিলেন—‘‘না জাগিলে ভারত ললনা/ এ ভারত বুঝি জাগে না জাগে না।’’ ভারত জাগরণের এই কাজটি যেন নতুন রূপে শুরু করেছেন শাহিন বাগের বিলকিস দাদি, পার্ক সার্কাসের আসমাত জামিল, বেথুয়াডহরির সুফিয়া বিবিরা।