ফাইল চিত্র।
আপন ‘বিদ্রোহ’-এর ধ্বজা গুটাইবার সময় দলীয় নেতা-কর্মীদের আবেগের তন্ত্রীতে ফের একটি ঝঙ্কার তুলিয়াছেন তৃণমূল সাংসদ তথা অভিনেতা শতাব্দী রায়। দলে তাঁহার ‘গুরুত্বহীন’ অবস্থান লইয়া ক্ষোভে তিনি প্রকাশ্যেই বেসুরে গাহিয়াছিলেন। তাহাতে দলত্যাগের ইঙ্গিতও নিহিত ছিল। সময়োচিত রাজনৈতিক কৌশলে তাঁহার জন্য দুয়ার খোলাও রাখিয়াছিল বিজেপি। তৃণমূল নেতৃত্বের তৎপরতায় অবশ্য শতাব্দী আপাতত পদ্মে স্থিত হন নাই। কিন্তু নিজের ক্ষোভ প্রশমনের কথা বলিতে গিয়া তিনি আরও যাহা বলিয়াছেন, তাহা তাঁহার দলের উপরতলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হইবার কথা। লোকসভা নির্বাচনে তিন বার জয়ী সাংসদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন, তৃণমূলে যাঁহারা ‘বেসুরো’ বলিয়া চিহ্নিত হইতেছেন, তাঁহাদের বক্তব্য সকলই অসার নহে। ফলে কে কী বলিতে চাহেন, তাহা ধৈর্য সহকারে শুনিবার বিবেচনাবোধ নেতৃত্বের নিকট প্রত্যাশিত। শতাব্দীর এই উপলব্ধি আদৌ তৃণমূলের উচ্চমহলের শ্রবণগোচর হইয়াছে কি না, হইলেও শীর্ষ নেতাগণ ইহার অন্তর্নিহিত বার্তাটি সম্যক অনুধাবন করিতে চাহিবেন কি না— তাহা একান্ত ভাবে ওই দলের নিজস্ব বিষয়। তবে তিনি যাহা বলিয়াছেন, তাহার ব্যঞ্জনা সমসময়ের রাজনীতিতে বৃহত্তর মাত্রা বহন করে। কথাগুলির তাৎপর্য সেখানেই।
ঘটনা হইল, ভারতে রাজনৈতিক দলগুলির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দিনে দিনে সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হইতেছে। ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের কোনও সিদ্ধান্ত বা কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রশ্ন নৈব নৈব চ! নীরবতাই যেন আনুগত্যের অন্যতম অভিজ্ঞান। অন্যথায় নেতৃত্বের রোষানলে দগ্ধ হইবার আশঙ্কা। পরিস্থিতিটি প্রকৃত প্রস্তাবে এই রূপ: কেহ মুখ বুজিয়া সব মানিয়া না লইলে দলের ক্ষমতাবানদের নজরে তিনি ‘শত্রু’ বলিয়া গণ্য হইবেন এবং তাঁহাকে ব্রাত্য করা হইবে। কিন্তু, রাজনৈতিক দল কোনও বদ্ধ কারাগার নহে। প্রতিবাদী স্বর স্তব্ধ করিয়া রাখা দুরূহ। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলে ইদানীং যে ভাঙন-পর্ব চলিতেছে, তাহার উৎস সন্ধানে নামিলেও শেষ অবধি এই সত্যে উপনীত হইতে হয়। যেমন, যাঁহারা ইতিমধ্যেই ওই দল ছাড়িয়াছেন বা ছাড়িবার জন্য কোমর বাঁধিতেছেন, তাঁহাদের ক্ষোভের মূলে আছে দলের শীর্ষ স্তরের কিছু সিদ্ধান্তের সহিত সহমত হইতে না-পারা। রাজনীতির ভাষায় তাহাকে আদি-নব্য দ্বন্দ্ব বা ক্ষমতার লড়াই, যে তকমাই দেওয়া হউক— আদতে বিষয়টি হইল দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া উপরতলার চাপানো ইচ্ছাকে বিনা বাক্যব্যয়ে শিরোধার্য করিতে কিছু নেতার আপত্তি। হয় নবীনের উদ্ধত বাড়বাড়ন্ত সহিয়াও চুপ থাকিতে হইবে, নচেৎ দলে প্রাপ্য মর্যাদা মিলিবে না— ইহাই যেন শর্ত। ফলে, সংঘাতও বাড়িতেছে।
কংগ্রেসের কথা মনে পড়িতে পারে। রাহুল গাঁধীর নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিবার ‘অপরাধ’-এ দলের বেশ কয়েক জন প্রবীণ নেতাকে অনতিবিলম্বে মাঠের বাহিরে বসাইবার উদ্যোগ করা হইল। বিজেপি ও সিপিএমের মতো গঠনতান্ত্রিক শৃঙ্খলায় ঋদ্ধ দলেও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ছবিটি কার্যত একই। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ধরনধারণ স্পষ্ট ভাবে তাহা দেখাইতেছে। শীর্ষ স্তরের সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত ভাবে মানিয়া না লইলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নানা পথ খোলা। এমনকি দলে কোণঠাসা হইতে হইতে প্রতিবাদী নিজেই নির্গমনের রাস্তা খুঁজিয়া লইতে পারেন! অর্থাৎ, ইহা কোনও বিশেষ দলের সমস্যা নহে, দলমতনির্বিশেষে ভারতীয় রাজনীতির দস্তুর। বলিতেই হইবে, সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে ইহা বিপজ্জনক লক্ষণ। পতাকার রং ভিন্ন হইলেও সব দলেরই অন্তরে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা কম-বেশি বাসা বাঁধিয়া আছে। নিজ গৃহে মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিতে যাঁহারা কৃপণ, দেশ বা রাজ্যের জনগণকে তাঁহারা অধিক কী দিবেন!