পর পর দুইটি ঘটনায় ভারতীয় গণতন্ত্রের কিছুটা মুখরক্ষা হইল কি? প্রথম ঘটনা দিল্লিতে। দুই মাসেরও বেশি ধরিয়া রাজধানী যে বিপুল অবরোধ দেখিতেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সে বিষয়ে এখনও কোনও উদ্যোগের চিহ্ন না দেখা গেলেও শেষে সর্বোচ্চ আদালত আন্দোলনকারীদের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে মধ্যস্থতার নির্দেশ দিল। আন্দোলনকারীদের সহিত এই আলোচনার দায়িত্ব অর্পিত হইল দুই প্রখ্যাত আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে এবং সাধনা রামচন্দ্রনের উপর। আইনজীবীদের নির্বাচন বলিয়া দেয়, নিরপেক্ষ বিচার সুপ্রিম কোর্টের অভীষ্ট। মাননীয় বিচারপতির মন্তব্যেও স্পষ্ট, প্রশাসনের ভূমিকায় তিনি ক্ষুব্ধ। রাজধানীর রাজপথ আটকাইয়া আন্দোলন যেমন বাঞ্ছনীয় নয় বলিয়া তিনি মত দিয়াছেন, তেমনই সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাইবার অধিকারটিকেও তিনি গুরুত্ব দিয়াছেন। কেন কেন্দ্রীয় প্রশাসন এত দিন কোনও ভাবে সমস্যা মিটাইবার চেষ্টা করে নাই, কেন আন্দোলনকারীদের সহিত আলোচনায় বসে নাই, ইত্যাদি প্রশ্ন করিয়াছেন। শাসনবিভাগের এই বিপুল দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দাম শেষ অবধি বিচারবিভাগকে মিটাইতে হইতেছে— ইহা একেবারেই বাঞ্ছিত নহে। তবে কিনা, ভারতীয় গণতন্ত্রের বর্তমান বিপন্নতার মধ্যে অন্তত কোনও পক্ষ হইতে যে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করিবার প্রয়াস হইল, তাহাই এখন আশ্বাসদায়ক।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটিয়াছে আমদাবাদে, প্রধানমন্ত্রীর শহরে। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় মুক্তকণ্ঠে নাগরিকের প্রতিবাদের অধিকার সমর্থন করিয়াছেন। বলিয়াছেন, ইহা গণতন্ত্রের একটি অত্যন্ত মৌলিক বৈশিষ্ট্য, এবং তার জীবনদায়ী নিরাপত্তাসূচক বা সেফটি ভালভ্। যে কোনও প্রতিবাদকে অ্যান্টি-ন্যাশনাল বলিয়া দাগাইয়া দিবার ধারাটি সাংবিধানিক শাসনের পক্ষে ভয়ানক বিপজ্জনক— গণতন্ত্রের একেবারে গোড়াতে গিয়া তাহা আঘাত করে। একই সঙ্গে নাগরিক অধিকারের প্রতি এই দ্বিধাহীন সমর্থন, এবং সরকারি কার্যধারার প্রতি দ্ব্যর্থহীন ইঙ্গিত— উভয় দিক দিয়াই বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বক্তব্য দেশবাসীর জন্য এক অতি-প্রতীক্ষিত প্রাণবায়ুর ঝলক। ভারতবাসী আজ তাহার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির আশ্বাসবাক্যের মুখাপেক্ষী হইতেছেন, ইহা নিশ্চয় নির্ভেজাল সুসংবাদ নহে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই আংশিক-সুসংবাদটিও অতি প্রয়োজনীয়— গণতান্ত্রিক দেশ ও তাহার সংবিধান যে বিলুপ্তপ্রায় নহে, তাহার বার্তা।
পরিস্থিতি ঠিক কেমন দাঁড়াইয়াছে, বুঝিবার জন্য আর যুক্তিতর্ক লাগে না। এখন আন্তর্জাতিক মহলেও ভারতের গণতন্ত্র-হানির ‘গুণগান’ ছড়াইয়া পড়িয়াছে। পাকিস্তানের এক উচ্চ আদালতে বিচারক নাগরিক অধিকার রক্ষার পক্ষে যুক্তি দিয়া বলিয়াছেন যে, ও দেশ তো ভারত নহে, ওখানে নাগরিকের অধিকার ভঙ্গ ঘটিতে দেওয়া যাইবে না। পাক রাষ্ট্রের পক্ষে ইহা একটি সুযোগসন্ধানী অতিশয়োক্তি, সুতরাং প্রবল প্রতিবাদযোগ্য— এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু মোদী সরকারকেও ভাবিতে হইবে, ভারতীয় রাষ্ট্রকে অমর্যাদার কোন অতলে টানিয়া নামানো হইয়াছে যাহাতে এমন কথা তাহাদের ঘোষিত শত্রুদেশ বলিতে পারে। ২০২০ সালের গোড়ায় জানা গেল, ২০১৯-এর গণতান্ত্রিক সূচকে ভারত পূর্বাপেক্ষা দশ স্থানাঙ্ক নামিয়া গিয়াছে। ২০১৮ সালে বিশ্বে তাহার স্থান ছিল ৪১, ২০১৯-এর শেষে ৫১। এই সূচকের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা: নাগরিক অধিকার। ভারতে এখন নাগরিক নিরাপত্তার যে হাল অতিশয় করুণ, মতপ্রকাশের পরিসর বিষম সঙ্কুুচিত, ইহা এখন তর্কাতীত বিষয়, আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত ও আলোচিত। সুপ্রিম কোর্ট ও মহামান্য বিচারপতির বক্তব্যে তাই কিছু আশ্বাস মিলিল। মূল্যবান আশ্বাস।