নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকেই ভারত ও চিনের মধ্যে আস্থাবর্ধক পদক্ষেপের (কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজ়ার্স বা সিবিএম) উপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। লাদাখের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেই প্রক্রিয়াকে প্রবল ধাক্কা দিল। গালওয়ান উপত্যকার অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকায়, পাঁচ দশকেরও বেশি পরে, আবারও হিংসার স্রোত। ভারত-চিনের অস্থির সম্পর্কের পক্ষে তা একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। পৃথিবী এখন এমন শত্রুর সঙ্গে লড়তে নাজেহাল যার কাছে এই সব সীমান্ত সমস্যা কিংবা ভূখণ্ড অধিকারের দাবি খুবই তুচ্ছ। দুর্ভাগ্য, এমন এক সময়েই এত রক্ত ঝরল এই এলাকায়। কোভিড-১৯ হাজার হাজারে ভারতীয় ও চিনার প্রাণ কাড়ছে, উভয়েরই অর্থনীতিকে ধ্বস্ত করছে। কোথায় সেই শত্রুর বিরুদ্ধে দু’দেশ হাতে হাত মিলিয়ে লড়বে, তার বদলে নেশন-মন্ত্রে বশীভূত দুই জাতিরাষ্ট্র একে অপরের দিকে তরোয়াল তুলে ধরল!
আমরা আজ ভুলতে বসেছি যে, অতীতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা চিন ও ভারতের সভ্যতার মধ্যে অভিনব মেলবন্ধন রচনা করেছিলেন। দ্বারকানাথ কোটনিস ও অন্য ভারতীয় চিকিৎসকদের ভূমিকাও বিস্মৃতপ্রায়। দু’দেশই যখন জাপানি আগ্রাসনের কবলে পড়েছিল, সেই সময়ে চিনের হয়ে জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন কোটনিস-সহ চিকিৎসকরা। দুই দেশের বন্ধুতাপূর্ণ সম্পর্কের প্রদর্শনীর খাতিরে ভারতীয় ও চিনা নেতাদের শীর্ষ স্তরের সফরের সময়ে বার বার এই সব ঘটনার প্রচার চলে। কিন্তু অথচ এখন— এই সবই যেন বড় শূন্যগর্ভ, অসার। কারণ, ভারত ও চিনের সাধারণ মানুষ একত্রে যত কৃতিত্বেরই অধিকারী হন, দুই জাতিরাষ্ট্রের (নেশন স্টেট) কর্মকাণ্ড এবং অঞ্চলদখলের স্বার্থের সামনে সে সবই নস্যাৎ হয়ে যায়। দুই জাতিরাষ্ট্রই আমাদের আগেও নিরাশ করেছে। আরও এক বার করল।
১৯৬২-তে ভারত-চিনের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত মাত্র এক মাস স্থায়ী ছিল। কিন্তু আজও দু’দেশের মধ্যে তা নিয়ে গুরুতর অসন্তোষ রয়ে গিয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে— জাতীয়তাবাদের বাড়াবাড়ি, অঞ্চলদাবি নিয়ে বাগ্-বিতণ্ডা, পারস্পরিক আস্থার অভাব, বৃহত্তর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থভাবনা।
প্রতি বার রাষ্ট্রীয় সফরের পর অনেক অলঙ্কারবহুল সরকারি ঘোষণা হয় বটে, কিন্তু দু’দেশের কেউই এই সব বাধা এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ অতিক্রম করার কথা ভাবতে পারে না। ভিসা ব্যবস্থা, তথ্য আদানপ্রদানের বিধিনিষেধ, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক মেলামেশায় সরকারি নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা, এই সব দিয়ে দু’টি রাষ্ট্রই সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিস্তর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। দু’দেশের মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া ওই বেড়াতেই আটকে যায়।
১৯৮৮-তে রাজীব গাঁধীর গুরুত্বপূর্ণ চিন সফরকালে একটা পরিকল্পনা হয়েছিল যে, বাণিজ্যিক আদানপ্রদান বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে, সীমান্ত বিষয়ক আলোচনায় অগ্রগতির প্রয়াসও চলবে। না, কোনও পরিবর্তন এল না দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে, পরিকল্পনার মেয়াদ হল উত্তীর্ণ। ঘটনা হল, বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ বেশ ভাল হওয়া সত্ত্বেও সেগুলির নিজস্ব জটিলতা তৈরি করছে। এবং তারও প্রাথমিক কারণ— জাতিরাষ্ট্রগত নীতির হস্তক্ষেপ। সুতরাং, এ বার বোধহয় জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোটা সরিয়ে রেখে ভাবার সময় এসেছে। তবেই সংযোগ বা আদানপ্রদানের বিষয়গুলি একেবারে নতুন করে শুরু করা যাবে।
অসরকারি অলাভজনক গোষ্ঠী ‘ওয়েস্ট হেভেনস’ সম্প্রতি শাংহাইয়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে এক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল, যার মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল চৈনিক ও ভারতীয় ঘরানার মিশ্রণ। দেখার মতো ভিড় হয়েছিল অনুষ্ঠানটিতে। তাঁদের অনেকেই জানালেন, ভারতের সমাজসংস্কৃতিতে তাঁরা মুগ্ধ। ওয়েস্ট হেভেনস আগেও এমন কিছু অনুষ্ঠান করেছে। ভারত থেকে নব্যচেতনার অগ্রদূত শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, দেখিয়েছে স্বতন্ত্র ভাবনার কিছু সিনেমা। এর দর্শক গোষ্ঠী অবশ্য কিছু আলাদা, ভিন্ন রুচির দর্শক। বলিউড ব্লকবাস্টার যাঁরা দেখেন, তাঁরা নন।
সাধারণ বৌদ্ধমতাবলম্বী চিনা, শিক্ষাব্রতী, শিল্পী, পর্যটক এবং সংবাদকর্মীদের মধ্যেও এমন আগ্রহী মানুষ মেলে। যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রোল করেন, আমেরিকার ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর সমীক্ষায় যাঁদের দেখা মেলে, যাঁরা যোগকেন্দ্রগুলিতে আনাগোনা করেন, তাঁদের থেকে এই মানুষগুলোর ভারত বিষয়ক বোধ প্রচণ্ড আলাদা। প্রতি বার সীমান্তে উত্তেজনার ফুলকি উঠলে বা চিনের সরকারি মুখপত্র গ্লোবাল টাইমস-এর মন্তব্য-কলামের নিবন্ধে শ্লেষ টগবগ করে ফুটলেও ভারত দেশটি নিয়ে তাঁদের অনুরাগে ভাটা পড়ে না। মনে রাখতে হবে, এঁরা কিন্তু চিন দেশে ভারতীয় সমাজ ও ভাবধারার প্রধান প্রবক্তা হওয়ার সামর্থ্য রাখেন। ভারত-চিন সম্পর্কের যোগসূত্র খুঁজে দেওয়ার চাবিটিও এঁরা দিতে পারেন। দুর্ভাগ্যবশত, ভারত সরকারের ভিসা ব্যবস্থা এই গোষ্ঠী বা এই বিশেষ মানুষগুলিকে চিনতে ব্যর্থ হয়।
ঠিক একই ভাবে, চিন সরকারও এই ধরনের গোষ্ঠীর সম্ভাব্য ক্রিয়াকলাপে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুশীল সমাজভুক্ত গোষ্ঠীকে বিধিনিষেধের গণ্ডিতে বেঁধে রাখে, প্রকাশমাধ্যমগুলির লাগামও শক্ত ভাবে ধরে রাখে। যদিও এ সব নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য যে সব সময়ই ভারত, তা নয়। কিন্তু ভারত ও চিনের বেশ কিছু মানুষ জাতিরাষ্ট্রগুলির এই অঞ্চল অধিকার ও ভূ-রাজনীতির স্বার্থনেশার পরিধির বাইরে বেরোতে চান। স্বাভাবিক কথোপকথন, সহজ আলাপচারিতার প্রত্যাশা করেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় স্বার্থে চালিত হাজারো ঝঞ্ঝাটে তাঁদের এই সুস্থ মত বিনিময়ের প্রক্রিয়া প্রবল ভাবে ব্যাহত হয়।
এই প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্কে অবস্থিত দ্য নিউ স্কুলের ‘ইন্ডিয়া-চায়না ইন্সটিটিউট’-এর উল্লেখ করা দরকার। দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বিভাগটি শিক্ষাবিদ ও পেশাদারদের সহায়তা জুগিয়ে চলেছে। এঁদের মধ্যে আছেন পক্বমস্তিষ্ক প্রাজ্ঞরাও, আছেন উদীয়মান বিদ্বানরাও। তাঁদের কাজের ক্ষেত্র পরিবেশ-চর্চা, নাগরিক উন্নয়ন এবং ভারত ও চিন বিষয়ে গবেষণা। ভারতীয় ও চিনা জাতিরাষ্ট্রের প্রযোজিত মেধাবৃত্তের মাপা সংলাপ, নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি বিনিময় আর বিদেশমন্ত্রকের নজরদারিতে প্রকাশিত নিয়মিত যৌথ বিবৃতি বা ইস্তাহার— কড়া নিয়মকানুনে বাঁধা এই সব ‘কৃত্রিম’ আদানপ্রদানের থেকে নিউ ইয়র্ক শহরের মাধ্যমে এই কাজকর্মের মধ্যে ভারত-চিন সমন্বয়-ইচ্ছার প্রকাশ অনেক বেশি। এক দিকে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রটা বড়, সেই ক্ষেত্রের বিস্তৃতিও অনেক। অন্য দিকে, আদানপ্রদানের মধ্যে নিরাপত্তাও বেশি, সংকল্পের দৃঢ়তাও বেশি।
ভারত ও চিন, দুটো দেশকেই একটা কথা কবুল করতে হবে। সঙ্কট শুধু সীমান্ত-বিবাদ কিংবা তিব্বত-সংক্রান্ত অচলাবস্থাতেই সীমাবদ্ধ নয়। পাঁচ দশক আগে পরিস্থিতি যতটা প্রতিকূল ছিল, এখন কিন্তু সমস্যা তার থেকেও অনেক খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে। সুতরাং, দুই দেশের পরস্পরের সম্পর্কে ধারণা তৈরি এখন খুব জরুরি।
সময়টা কিন্তু এসে গিয়েছে। বুনিয়াদি স্তরে যোগাযোগ ও ভাববিনিময়ের উপর বিধিনিষেধ এ বার শিথিল করতেই হবে জাতিরাষ্ট্রগুলিকে। মানুষ মানুষের সঙ্গে কেমন ভাবে মতের আদানপ্রদান করছে, প্রতিনিয়ত তার নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি থেকে বিরত থাকতে হবে। যে বিরল কিন্তু সদিচ্ছাময় গোষ্ঠীগুলির কথা বলছিলাম, তাদের প্রয়োজন এখন আগের চেয়ে আরও বেশি— ভারত ও চিনে তো বটেই, এমনকি ভারত আর চিনের বাইরেও। এই মানুষগুলি তাঁদের অভিজ্ঞতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নতুন মঞ্চ প্রস্তুত করতে পারবেন, যেখানে ই দুই দেশের মানুষ বৃহত্তর, মজবুত-তর, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে বাঁধা পড়তে পারে। এতখানি স্বতঃস্ফূর্ততা ও গভীরতা তৈরি করা জাতিরাষ্ট্রের পক্ষে অসাধ্য।
এমনই এক ‘বিরল’ মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলেছিলেন, উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতির শত্রু। গত শতাব্দীর বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ ভারত-চিন সম্পর্ককে নতুন আলোয় দেখার চেষ্টা করেছিলেন। একশো বছর পরে, আবার সেই নতুন আলোতেই দেখতে হবে ভারত-চিনের যোগাযোগকে। দুই সমাজকে কাছাকাছি আনতে ভরসা করতে হবে জাতি-রাষ্ট্রবাদের বাইরে সেই বিশেষ বিরল বোধ ও রুচিসম্পন্ন, মুক্তমনা মানুষ, গোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠানের উপরেই। কেননা ‘জাতিরাষ্ট্র’ আবারও আমাদের বিপদের গভীর আঁধারে ঠেলে দিয়েছে!
ইতিহাস বিভাগ, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, শাংহাই