শীতলা-মনসার খাসভূমে
Coronavirus

এ দেশে মেয়েদের পর্যাপ্ত পরিমাণে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে না

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি পুরুষ-মহিলার প্রায় সমান, কিন্তু গোটা বিশ্বে এ রোগে পুরুষদের মৃত্যুহার বেশি।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২০ ০০:৫৩
Share:

বসন্তের প্রকোপ থেকে রেহাই দেবেন শীতলা, কলেরা থেকে ওলাইচণ্ডী। সেই ধারা বেয়ে এখন এসেছেন করোনামাতা। সংক্রামক রোগের থেকে সন্তানস্নেহে আগলাবেন, এমন ভরসা চাই বলেই হয়তো দেবীর কল্পনা। কিংবা হয়তো জিনবিজ্ঞানের বার্তা ছড়ানোর আগেই লোকে লক্ষ করেছিল, ছেলেরা যতই গায়ের জোরের বড়াই করুক, ছোঁয়াচে রোগকে হারিয়ে দেওয়ার জোর মেয়েদের বেশি।

Advertisement

কোভিড-১৯ রোগটার কথাই ধরা যাক। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি পুরুষ-মহিলার প্রায় সমান, কিন্তু গোটা বিশ্বে এ রোগে পুরুষদের মৃত্যুহার বেশি। মেয়েদের যত মৃত্যুহার, তার প্রায় ডবল পুরুষদের। যেমন চিনের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, একশো জন মেয়ের সংক্রমণ হলে মারা যায় ১.৭ জন, আর একশো জন পুরুষ সংক্রমিত হলে ২.৮ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার একটা কারণ দেহগত পার্থক্য। মেয়েদের জিনে থাকে দুটি এক্স ক্রোমোজ়োম, যা মেয়েদের রোগ-প্রতিরোধের বাড়তি ক্ষমতা জোগায়। আবার স্ত্রী-হরমোন ইস্ট্রোজেন শ্বাসব্যবস্থার সংক্রমণ থেকে অনেকটা সুরক্ষা দেয় মেয়েদের। সেই সঙ্গে সমাজগত কারণও রয়েছে। মেয়েদের মধ্যে মদ্যপান, ধূমপানের হার কম বলেও তাদের ঝুঁকি কম। কাজের জন্য পুরুষ বেরোয় বেশি বলেও তাদের ঝুঁকি বাড়ে। এ সব কারণে মেয়েদের প্রাণ গোটা বিশ্বেই পুরুষের তুলনায় সুরক্ষিত কোভিডের মতো রোগের থেকে।

কিন্তু মেয়েদের জোর বেশি বলেই কি দেবীমূর্তির কল্পনা? না কি মেয়েরা বোঝে, প্রকৃতি যতই সহজাত শক্তি দিক, ভাগ্য সদয় না হলে প্রাণ রাখা কঠিন? শীতলা-মনসার খাসভূমে মেয়েদের মৃত্যুহার বেশি। জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার দৈনিক বুলেটিনে প্রকাশ করল পুরুষ আর মেয়েদের মৃত্যুহার। দেখা যাচ্ছে, বাংলায় মেয়েদের মৃত্যুহার বেশি পুরুষদের চেয়ে (৫.৪০ শতাংশ, পুরুষদের ৪.৪৮ শতাংশ)। ভারতের ছবিটাও একই রকম (পুরুষের মৃত্যুহার ২.৯ শতাংশ, মেয়েদের ৩.৩)। গোটা বিশ্বে যে ছবি, ভারতে তার উল্টো। এমনই লিখেছেন ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা, এক সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রে, যা প্রকাশিত হয়েছে ‘জার্নাল অব গ্লোবাল হেলথ সায়েন্সেস’-এ। ২০ মে অবধি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তাঁরা অঙ্ক কষেছিলেন।

Advertisement

এই পরিণতি আরও আশ্চর্য মনে হতে পারে, যখন লক্ষ করা যায় যে ভারতে আক্রান্তদের যে সংখ্যা মিলেছে, তার মধ্যে মহিলা অনেক কম। এখানেও ভারত ব্যতিক্রম। ইটালিতে পুরুষ আক্রান্ত কিছু বেশি (১০ মহিলা পিছু ১৩ পুরুষ), দক্ষিণ কোরিয়ায় কিছু কম (১০ মহিলা পিছু ৬ পুরুষ)। সেখানে ভারতে কোভিড-আক্রান্তদের মধ্যে ১০ জন মহিলা পিছু ৩১ জন পুরুষ।

আর চিন? চিনে করোনা-আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষ-মহিলা একেবারে আধাআধি। কিন্তু মেয়েরা করোনা-আক্রান্তদের ৫০ শতাংশ হলে কী হবে, মৃতদের মধ্যে তারা ৩১ শতাংশ। সেখানে ভারতে করোনায় আক্রান্তদের ২৪ শতাংশ মহিলা, কিন্তু করোনায় মৃতদের মধ্যে তারা ২৭ শতাংশ। এপ্রিলের গোড়ায় এই বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছিল ‘গ্লোবাল হেলথ ৫০-৫০’ নামে এক সংস্থা। ফের ২০ মে পর্যন্ত পরিসংখ্যান নিয়ে ভারতীয় ও মার্কিন গবেষকরা যে তথ্য দিলেন তাতে দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা আক্রান্তের ৩৪ শতাংশ, কিন্তু মৃতের ৩৭ শতাংশ। আক্রান্তদের মধ্যে অনুপাত কম কিন্তু মৃতদের মধ্যে বেশি, এই নকশাটা বার বার দেখা যাচ্ছে।

এর মানে কী? একটা মানে খুব সম্ভবত এই যে, কত মেয়ে বাস্তবিক আক্রান্ত হচ্ছে, তার পুরো ছবিটা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ মেয়েদের থেকে যথেষ্ট নমুনা সংগ্রহ বা পরীক্ষা হচ্ছে না। ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুমিত মজুমদার মনে করেন, মেয়েদের প্রয়োজনকে সব ব্যাপারেই অবহেলা করা হয়, চিকিৎসার প্রয়োজনকে তো বটেই। করোনার ক্ষেত্রেও এমন হবে, আশ্চর্য নয়। তা বলে মেয়েদের বাড়তি ঝুঁকি নেই, এমনও বলা চলে না। যেমন, তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকাংশই মহিলা। তাঁদের সংক্রমণের সম্ভাবনা যথেষ্ট। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে না।

উত্তরবঙ্গের এক আশাকর্মী জানালেন, তাঁর ব্লকের আড়াইশো আশাকর্মীর মাত্র ৫০-৬০ জনের পরীক্ষা হয়েছে। দু’জন পজ়িটিভ বেরিয়েছে, কিন্তু সেই কর্মীরা যে অঞ্চলে কাজ করেন, সেখানকার অন্য আশাকর্মীদের পরীক্ষা করা হয়নি। ইটালি, স্পেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গিয়েছে, কোভিড-আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের ৬০-৭০ শতাংশই মহিলা। আর একটু মনোযোগ কি আশাকর্মীদের প্রাপ্য ছিল না?

দ্বিতীয়ত, ভারতে মেয়েদের রক্তাল্পতা বেশি, ‘কো-মর্বিডিটি’ও খুব কম নয়। ডায়াবিটিসে আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেক মহিলা। গ্রামের মহিলাদের মধ্যেও দশ জনে অন্তত এক জন ডায়াবিটিসে ভোগেন, যদিও তাঁরা হয়তো নিজেরাও তা জানেন না। কেবল বৃদ্ধা, অসুস্থরাই বিপন্ন, এমনও নয়। দেখা যাচ্ছে, ৪০-৪৯ বয়সি মেয়েদের মৃত্যুহারও পুরুষদের তুলনায় একটু বেশি। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের পরিবারের মহিলাদের ঝুঁকিও বাড়ছে। বাইরে কাজ না-করার নিরাপত্তা যদি মেয়েরা এত দিন পেয়ে থাকেন, অনেকে এ বার তা হারাবেন। এইচআইভি রুখতে পরিযায়ী শ্রমিক, ট্রাক চালকদের স্ত্রী, যৌনসঙ্গীদেরও রক্তপরীক্ষার নীতি হয়েছিল। আজ পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবারের মহিলাদের কোভিড পরীক্ষা, নজরদারির নীতি চাই।

গ্রামের মেয়েদের রোগ অজানা থেকে যাওয়ার ঝুঁকি সর্বাধিক। পশ্চিমবঙ্গে যত পরীক্ষা হচ্ছে, তার দুই-তৃতীয়াংশই কলকাতার হাসপাতালে। রাজ্যের জেলাওয়াড়ি তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় আক্রান্তদের মধ্যে মেয়েরা ৩৫ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের (৩৪ শতাংশ) কাছাকাছি। কিন্তু যত দূর জেলা, তত আক্রান্ত মেয়ের অনুপাত কম। হাওড়ায় ২৬ শতাংশ, বাঁকুড়ায় ৪ শতাংশ, উত্তর দিনাজপুরে আধ শতাংশ। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, তফাতটা আসলে কোভিড পরীক্ষার সুযোগের হেরফেরে। উত্তরবঙ্গের এক চিকিৎসক জানালেন, “উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে যাঁরা পরীক্ষা করাতে এসেছেন, এক-এক জনের কাছে অ্যাম্বুল্যান্স ছ’-সাত হাজার টাকাও নিচ্ছে। ক’জন মেয়ে আসতে পারবে?”

আবার রোগের লক্ষণ ধরা পড়লেও কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা অনিশ্চিত। ওই আশাকর্মীর আক্ষেপ, এলাকার কারও জ্বর রিপোর্ট করলে, এমনকি কোভিড হেল্পলাইনে ফোনে জানালেও জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কোনওই প্রতিক্রিয়া মিলছে না। “আমাদের কাজে কার লাভ হচ্ছে বুঝতে পারছি না”, বললেন ওই আশাদিদি।

এই ছবি কেবল ভারতে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে। পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশে একটি সমীক্ষা করে রাষ্ট্রপুঞ্জ দেখেছে, অর্ধেক মহিলা এখন প্রয়োজনে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। চিকিৎসক থাকলেও তাঁর কাছে পৌঁছতে মেয়েদের আরও বেশি সময় লাগছে পুরুষদের থেকে। এক কথায়, ইউরোপ-আমেরিকায় জন্মালে কোভিড হওয়ার পরেও যে মেয়েগুলো বেঁচে যেত, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে জন্মাল বলে তাদের অনেকেই বাঁচল না।

হয়তো মেয়েদের হাতে আরও কিছু ইন্টারনেট-সহ মোবাইল দেওয়া গেলেও অনেকে বেঁচে যেত। রোগ সম্পর্কে জানার, আগাম সতর্ক হওয়ার এই তো এখন প্রধান উপায়। বাংলাদেশ, পাকিস্তানে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা কোভিড সম্পর্কে আগাম তথ্য পাননি, কিংবা বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মেয়েরাই বেশি।

কোভিড-১৯ দেখার পর মেয়েদের বিপন্নতার প্রসঙ্গটি সংবাদে প্রধানত এসেছে গার্হস্থ্য হিংসা বৃদ্ধির উদ্বেগের দিক থেকে। কখনও বা মেয়েদের কাজ হারানো, দারিদ্র গভীর হওয়ার আশঙ্কায়। প্রসূতির স্বাস্থ্য-পরিষেবা না মেলার সম্ভাবনায়। এর প্রতিটিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মহামারির যে প্রধান উদ্বেগ, সংক্রমণ ও মৃত্যু, তার থেকে বিপন্নতাও মেয়েদের খুব কম নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement