ঢাকার বন্ধু সাংবাদিক শাজাহান মল্লিক দুটো প্রশ্ন করলেন। প্রশ্ন এক: “আপনারা তিস্তা নদীর পানি কবে দিচ্ছেন?” প্রশ্ন দুই: “আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদরা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশিদের আর কত দিন ‘উইপোকা’-র সঙ্গে তুলনা করবেন?” প্রথম প্রশ্নটি অতীতের একটি অভিজ্ঞতা মনে করাল। ঢাকার রেস্তরাঁর মালিক আমাকে বলেছিলেন, “গঙ্গা থেকে আরও পানি দ্যান, তা হলে আরও ভাল এবং বড় মাছ খাওয়াইব।”
জ্যোতি বসু এবং ইন্দ্রকুমার গুজরালের বিচক্ষণ রাজনীতির উপর ভরসা করে সেই অতীতে গঙ্গাজলের বণ্টনের সমস্যার সমাধান সম্ভব মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের কূটনীতিবিদ হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বলেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল প্রকৃত ‘স্টেটসম্যান’-এর মতো আচরণ করলেন।”
প্রশ্ন হল, বর্তমান নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি অনুরূপ ‘স্টেটসম্যানশিপ’ দেখাবেন? এখনও পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী বলছেন যে, তিস্তা অনেক সময়ই শুষ্ক থাকে, তাই তিস্তার জল বাংলাদেশকে দেওয়া সম্ভব নয়। নির্মোহ সত্য হল তিস্তার জলস্রোতের কিছুটা বাংলাদেশকে দিতেই হবে। না দিলে, বাংলাদেশ চিনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করবে। আশঙ্কাটি মাথায় রেখেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, তাঁর আপত্তি নেই। অর্থাৎ, বিতর্কিত বিষয়টির সমাধান নির্ভর করছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উপর।
আসছি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে। নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, অতি জটিল নাগরিকত্ব প্রশ্নের উত্তরে তাঁর সরকার এক জনকেও জোর করে বাংলাদেশে পাঠাবে না। কিন্তু আপাতত তাঁরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ভারতে ‘বসবাসকারী বাংলাদেশি’-দের উইপোকাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নেতা দিলীপ ঘোষ সরাসরি হুমকি দিয়েছেন, “নাগরিকত্বের বিধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। প্রয়োজনে অনুপ্রবেশকারীদের জবরদস্তি করে তাদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠাব।”
গূঢ় প্রশ্ন হল, কার মন্তব্যকে অগ্রাধিকার দেব— রাজার, না পারিষদদের? নরেন্দ্র মোদী নাকি বলেছেন, “অপরের কথায় কান দেবেন না,” কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁর বাক্সর্বস্ব অনুগামীদের তিনি তিরস্কার করেননি। ফলে, ভারতের প্রক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া পরিণত হয়েছে দু’মুখী পরস্পরবিরোধী বার্তায়। বার্তাবাহকেরা হলেন এক দিকে মোদী, অন্য দিকে অমিত শাহ আর দিলীপ ঘোষ। বাংলাদেশের নাগরিক উক্ত বন্ধু বললেন, “‘পরাক্রান্ত’ প্রধানমন্ত্রী অধীনস্থদের চুপ করতে বলছেন না কেন? তামাশা তো আমাদেরই সহ্য করতে হচ্ছে।”
দু’দেশের সম্পর্কের ভিতর আরও একটি বিতর্কিত মাত্রা যোগ করেছে বাংলাদেশে সক্রিয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস-এর অধীন হিন্দু স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের দশ শতাংশ হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত জানিয়েছেন, গত এক দশক হিন্দু এসএস বাংলাদেশে সক্রিয়। এদের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম রয়েছে। গবেষক তাপস দাস বলছেন, “হিন্দু এসএস-এর লক্ষ্য হিন্দুদের সঙ্ঘবদ্ধ করা এবং স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন। নির্বাচনে এই হিন্দু দল সরাসরি অংশ নেবে এবং নির্বাচনের পর ক্ষমতানির্ণায়কের ভূমিকা পালন করবে।” হিন্দু মহাজোটের প্রবক্তারা জানিয়েছেন— এক, তাঁদের পৃথক রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। দুই, বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। তিন, তাঁদের মূল কাজ হিন্দুদের সুরক্ষা।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এই কর্মসূচিকে সুনজরে দেখছে না। রাজনৈতিক হিসেবের দিক দিয়ে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে সে দেশের সংহত হিন্দু ভোটের একটা ভূমিকা থেকেছে অনেক কালই। সেই পরিস্থিতিতে, নতুন রাজনীতির ভূমিকা ঠিক কী দাঁড়াবে, এখনও দেখার।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ইচ্ছা করলেই চিনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের পরিমাণ তারা বাড়িয়ে নিতে সক্ষম। এই ভূ-কৌশলগত সহযোগিতার দৃষ্টান্ত, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গ নির্মাণে চিনের অবদান। রাশিয়ার সহযোগিতায়ও বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প।
অতএব, বাংলাদেশ ভারতের উপর পূর্ণত নির্ভরশীল নয়। অন্যান্য দেশের দ্বারস্থ হতেই পারে। চিন তো দরজা খুলেই রেখেছে। ভারত এই সহযোগিতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলে, বাংলাদেশের উত্তর হবে, ‘‘আপনাদের সকলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অটুট। দেশের সার্বিক কল্যাণের পদক্ষেপ করছি। রেষারেষির অবকাশ নেই।’’
এই পরিস্থিতিতে ভারতের করণীয় কী? শেখ হাসিনা তাঁর শাসনকালের দ্বিতীয় পর্বে ভারতকে অকাতরে সাহায্য করেছেন। প্রশ্ন, ভারত কি যোগ্য প্রতিদান দিয়েছে? যদি না দিয়ে থাকে, সম্পর্কটি মূলত এক তরফা হয়ে যাবে এবং ভারতের ভূকৌশলগত স্বার্থও বিঘ্নিত হবে। এই মুহূর্তে, অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এই বাস্তবটিকে স্মরণে রেখেই আমাদের এগোনো প্রয়োজন।
শেষ কথা, প্রতিবেশীকে ‘উইপোকা’ সম্বোধন ভদ্রোচিত তো নয়ই, স্বার্থবিরোধীও বটে।