নৈরাজ্য: পুলিশের চোখের উপরই যা খুশি তাই করা যায়, কলকাতার রাস্তায় অটোচালক ও পথচারীরা রোজ প্রমাণ করছেন। ছবি: সুমন বল্লভ
বাংলায় ‘আইনের শাসন’ ফিরিয়ে আনার সামান্য প্রয়াস শুরু হয়েছে। আইনের শাসন শব্দবন্ধটির বহুল প্রচলন হওয়ার পর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানি রডরিক বলেছিলেন যে অর্থনীতির ক্ষেত্রে এর ব্যবহার শুরু করার সময়ে তিনি নিজেও নিশ্চিত ছিলেন না এর প্রয়োগ এবং ব্যাপ্তি সম্বন্ধে। অর্থনীতি এবং সংশ্লিষ্ট রাজনীতিকে আইনের শাসন কত রকম ভাবে প্রভাবিত করে তার নজির ভূরি-ভূরি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং সরকারের তরফে গোঁজামিল দেওয়া বিভিন্ন বিলি-বণ্টন ব্যবস্থার কল্যাণে দেশ জুড়ে যাবতীয় অনিয়মই নিয়ম বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের কিছু বড় শহর এবং মফস্সলের অভিজ্ঞতা বলছে নাগরিকদের জন্যে যথেষ্ট চাকরি সৃষ্টি করতে না পারার মধ্য দিয়ে সরকারের দুর্বলতা প্রতিভাত হয়। বিষয়টা রাজনৈতিক সঙ্কটের পর্যায়ে গেলে সরকার অনিয়মের ব্যাপারে চোখ-কান বুজে থাকার ভান করে চলে। আইনরক্ষকদের কাছে বার্তা পৌঁছয় যে, অনিয়ম খুব বড় আকার ধারণ না করলে, প্রতিক্রিয়া না দেখাতে। সরকারি দফতরের কাজে অবহেলা থেকে রাস্তায় হকার থেকে অটোচালকের দাপট, সবই তো আইন মোতাবেক নিয়মবহির্ভূত। শুধু বাংলা বা ভারতে কেন, সারা পৃথিবীতেই নিয়মের ভাঙা-গড়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তার কিছুটা সরকারই জ্ঞানত করতে দেয়।
মজা হল, নিয়ম-ভাঙাকে সরকার কতটা প্রশ্রয় দিচ্ছে, তার মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালনার বিষয়ে তার যোগ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বহু বার এমন প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যেখানে বেশি অনিয়মের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, পুঁজি এবং দক্ষ শ্রম স্থান ত্যাগ করেছে। বিদেশি পুঁজির ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। একটি দেশে বা তার অন্তর্গত কোনও রাজ্যে পুঁজিনিবেশ করার আগে পুঁজিপতিরা সমীক্ষা করে থাকেন যে আর্থিক মানদণ্ড ছাড়াও রাজনৈতিক ভাবে অঞ্চলটি সুস্থির কি না, বা সোজা কথায় সে জায়গায় আইনের শাসন বলবৎ রয়েছে কি না। ক্রমাগত অশান্তি চলতে থাকলে সে জায়গা ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ করা হয়।
যে হেতু আইনের শাসন ব্যাপারটি একমাত্রিক নয়, ফলে রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ধর্মীয় সংঘর্ষ, চুরি-ডাকাতি, খুন, ধর্মঘট, রাস্তায় অবৈধ দখলদারি, অর্থাৎ সম্পত্তি সুরক্ষা আইন মানা হয় কি না, সব মিলিয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়। ব্যবসার ক্ষেত্রে সম্পত্তি সুরক্ষা আইন যেমন জরুরি, তেমনই গুন্ডা দমনে পুলিশ ডাকলে কাজ হয় কি না, সেটাও কম জরুরি নয়। আর এইখানেই সম্ভবত সরকারের দ্বৈত সত্তার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। দ্বৈত সত্তার একটি হল মানুষের জন্যে কল্যাণধর্মী কাজ করে যাওয়া, যার সুবিধার্থে আইনের শাসন জারি রাখা ভিন্ন পথ নেই। আর অন্যটি হল, যেন-তেন-প্রকারেণ ক্ষমতা ধরে রাখা। গদি না থাকলে তো অন্য সুবিধেও মিলবে না। আর গদি ধরে রাখার জন্যে আইনের শাসনে খানিকটা ঢিলে দিতেই হয়— বাইকে চড়া প্রচারবাহিনী এবং তার পিছনে তোলাবাজের অর্থ কোনওটাই সম্ভব হয় না।
নিয়ম-ভাঙার খেলা নিরামিষ নয় একেবারেই। রাস্তায় ইট, বালি, সিমেন্টের ব্যবসা করে গাড়ি চলাচলের পথ অবরুদ্ধ করা যায়, কলকাতার অধুনা মেয়রের বাড়ির চতুর্দিকে এটা হয়ে চলেছে। এই সামান্য অধিকারবোধ থেকেই আরও বড় নিয়ম-ভাঙার বীজ বপন করা যায়। রাস্তা আটকে ব্যবসা করলে বা পুলিশ চৌকির উল্টো দিকে মূত্র ত্যাগ করলে কারও যদি টুঁ শব্দটি করার সাহস না হয়, তার অর্থই হল যে আইন থাকে শুধু খাতায়-কলমে। আমাদের ছোটবেলায় হাল্লাগাড়ি বলে একটি জিনিস এই চাক্ষুষ অনিয়মগুলো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করত। মানে, পুলিশ একলাই ঘুষ নিত, এবং যে হেতু পুলিশের ছোট অংশ এটা করত, এবং অন্যরা নিয়মের প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রাখতেন। ফলে এতটা বাড়াবাড়ি চোখে পড়ত না। গত কুড়ি বছরে পুলিশের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলও অনিয়ম ঘটাচ্ছে অকাতরে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী কাজ করার মধ্য দিয়ে একটা বিদ্রোহী মনোভাব প্রকাশ পায় ঠিকই, যেমন রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে বাইক চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু এই ‘বিদ্রোহ’-এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যা খুশি করার লাইসেন্স এক বার দিয়ে দিলে কোন নিয়মটা ভাঙা যাবে না, তার নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকে কি? পিচের রাস্তায় লোহার খুঁটি পুঁতে কেওড়াতলা মহাশ্মশানের পাশেই যদি স্থায়ী পার্টি অফিস করা যায়, তা হলে যেখানে ইউ টার্ন করা নিষিদ্ধ সেখানে অটোরিকশা
কেনই-বা ইউ টার্ন করবে না? উদাহরণগুলো হযবরল’র মতো শোনাচ্ছে ঠিকই। পক্ষপাতদুষ্টও মনে হতে পারে। ভারতের অধিকাংশ শহরেই নিয়মমাফিক কিছু হয় না, তা হলে বাংলার দোষই বা শুধু চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো কেন? উত্তরে বলা যায়, মধ্য বা পশ্চিম ভারতের বড় বড় শহরে আইনের দুরবস্থা, আর পুরসভার অবহেলা, দুই-ই মাত্রাছাড়া নিশ্চয়, কিন্তু সেই জন্যেই যে সব বিষয়ে আমাদের রাজ্য এগিয়ে ছিল, বা এখনও এগিয়ে আছে, সেগুলো হারিয়ে ফেলা আত্মঘাতী, তা মনে করা দোষের নয় নিশ্চয়।
ঘটনা হল, বেনিয়মের বেড়াজালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও পথ হারাতে পারে। কোনও দেশে বা রাজ্যে আইনের শাসন আছে না নেই, তার প্রভাব ছড়ায় অনেক দূর— দেশের নিজস্ব ভাল-মন্দের সঙ্গে সঙ্গে তার আর্থিক বৃদ্ধির উপরেও। এক সময় মনে করা হত, বাজেট কিংবা মুদ্রার বিনিময়হার ঠিক রাখতে পারলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হবেই। সেই ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেখা যায় যে, সেখানকার সামগ্রিক আর্থিক নীতি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও অপশাসনই ডেকে এনেছিল বড় বড় বিপর্যয়। প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তী সময়ে ইউক্রেনে গিয়ে বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল যে, পরিকাঠামো, বণ্টনব্যবস্থা সবই উন্নত মানের হওয়া সত্ত্বেও সে সব দেশ স্বমহিমায় ফিরে আসতে পারেনি কেন। আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে— এটাই কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন তাঁরা। একটি সহজ হিসেবও সামনে আসে। আইনের শাসনে এক শতাংশ উন্নতি হলে মাথাপিছু রোজগার বাড়ে িতনশো শতাংশ। দক্ষিণ আমেরিকার চিলে এবং ভারতের সম্পর্কটি এই গোত্রের। চিলেতে আইনের শাসন ভারতের থেকে এক শতাংশ মতো উন্নত, আর মাথাপিছু আয় তিনশো শতাংশ বেশি। না, আইনের শাসনকেই একমাত্র কারণ বলা যায় না, তবে অন্যতম কারণ তো বটেই।
রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে আর্থিক বণ্টনের ক্ষেত্রেও আইনের শাসন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের হাতে থাকে। রাজ্যের নিজস্ব রোজগার এবং খরচ করার স্বাধীনতার বাইরে যে অর্থবরাদ্দ, সংবিধানের ২৮০ নম্বর ধারা অনুসারে অর্থ কমিশনের নিয়ম মেনে তা করা হয়। কোন বছরে কোন খাতে কত বাজেট বরাদ্দ করা হবে, সেটা রাজ্যের তরফে হিসেব পাঠানোর পর কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে অনুমোদিত হয়। এর মধ্যে থাকে শিল্প, পরিষেবা, কৃষি ইত্যাদির জন্য পরিকাঠামো সৃষ্টি ও রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দ। সমস্যাসঙ্কুল কাশ্মীর পর্যটনের স্বর্গভূমি। তবু তার যথার্থ মর্যাদা হয়তো সে কোনও দিনই পাবে না, কেননা পর্যটনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাজেট-বরাদ্দ রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি অনুযায়ী বাড়ে বা কমে।
রাজ্যে আইনের শাসন ভাল না খারাপ, এটা বরাদ্দের অন্যতম নির্ণায়ক বলে ভারতের রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে গত দশ বছরের অভিজ্ঞতা লক্ষ করা যেতে পারে। রাজ্যে আইনের শাসন খারাপ হলে কেন্দ্র পর্যটনশিল্পের বাজেটবরাদ্দ কমিয়ে দেয়। তবে সমৃদ্ধ রাজ্যের ক্ষেত্রে এই বরাদ্দ কমানোর হার তুলনামূলক ভাবে দরিদ্র রাজ্যের থেকে কম। অর্থাৎ, যে রাজ্য আর্থিক ভাবে উন্নত নয়, সেখানে যদি আইন-শৃঙ্খলার আরও অবনতি হয় তবে পর্যটন-খাতে কেন্দ্রীয় সাহায্য আসার পরিমাণ অনেকটা কমে। ফলে পরিকাঠামোর উন্নয়ন ধাক্কা খায়, নতুন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রয়াস বাধাপ্রাপ্ত হয়। চাকরি কমে, স্বনিযুক্তি প্রকল্পেও রোজগার কমে।
সুতরাং আইনের শাসন বজায় থাকলে যে শুধু মানুষ শান্তিতে থাকবেন তা-ই নয়, আর্থিক সমৃদ্ধিও বাড়বে। এবং ছোট ছোট অনিয়মের বিষয়ে মনোযোগ দিলে তবেই বৃহত্তর ক্ষেত্রে আইনের শাসন থাকতে পারে, সরকারকে এটাও মানতে হবে।
কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক, মতামত ব্যক্তিগত