সবার ভালর জন্য?
Two Children Policy

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি মানেই দুর্বলতম জনগোষ্ঠীর ওপর জুলুম

গোটা দুনিয়াতেই জনসংখ্যার প্রশ্নটা জড়িয়ে আছে ‘আমরা বনাম ওরা’-র তর্কে।

Advertisement

অলকা মালওয়াদে বসু

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

ছবি: সংগৃহীত

দেশের তেমন উন্নতি হচ্ছে না কেন, এই প্রশ্নের মুখোমুখি হলেই নেতারা জনসংখ্যার ‘সমস্যা’-র কথা তোলেন। মুশকিল হল, জনসংখ্যা বিষয়ে তাঁদের ধারণা সামান্যই। ভয় হচ্ছে, এত দিন তাঁরা মুখের কথায় যা বলতেন, দুম করে এক দিন সেটাই কোনও নতুন বিলের আকারে সামনে আসবে— ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল’। তাঁরা ঠিক কী করতে চান— জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে চান, দেশের জনসংখ্যা কমাতে চান, না কি কোনও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমাতে চান, এবং তাঁরা কেন ভাবছেন যে এই কাজগুলো করলে দেশের উপকার হবে— এই প্রশ্নগুলোর কোনও স্পষ্ট উত্তর ছাড়াই ভারত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটতে থাকবে।

Advertisement

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলেই ভারতে উন্নয়ন হচ্ছে না, এই কথাটাকে বহু ভাবে প্রশ্ন করা যায়। যেমন, ভারতীয় অর্থনীতির গতিভঙ্গের পিছনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ভূমিকা কতখানি, কেউ বিশদে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আজ ভারত ‘দুই সন্তান নীতি’ গ্রহণ করলেই কি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কক্ষপথ আমূল বদলে যাবে? যদি যায়ও, তাতে কি হঠাৎ আর্থিক বৃদ্ধির হারে গতি আসবে? আবার, কেউ মানুষের জীবনে, তাঁদের অধিকারের ওপর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতির প্রভাবের কথাও ভেবে দেখতে পারেন। এই লেখায় আমি সেই ব্যক্তিগত স্তরে প্রভাবের কথা বলব।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন ঠিক কী করতে চায়, আপাতত সে কথা ভাবা যাক। যাবতীয় অবিশ্বাস মুলতুবি রেখে ধরে নেওয়া যাক, এই আইনের পিছনে কোনও গভীর বিদ্বেষের আখ্যান নেই। তিন তালাক আইন, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্তি, বা সিএএ-এনআরসি-এনপিআর যতখানি ‘সবার ভালর জন্য’, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আইন তার চেয়েও অনেক বেশি ভাবে সর্বমঙ্গলার্থে হবে।

Advertisement

গোটা দুনিয়াতেই জনসংখ্যার প্রশ্নটা জড়িয়ে আছে ‘আমরা বনাম ওরা’-র তর্কে। গৃহবধূরা বলেন, গৃহসহায়িকারা বড় বেশি সন্তানের জন্ম দেন। বড়লোকেরা গরিবের সদাসক্রিয় যৌনজীবন নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। শহরের লোকেরা গ্রামের পরিবারের বৃহদায়তন দেখে ভুরু কোঁচকান। শিক্ষিতেরা অশিক্ষিতদের অপরিমিত

সন্তান উৎপাদনে বিরক্ত হন, উচ্চবর্ণের লোকেরা জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য নিম্নবর্ণের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন।

কোনও বাছবিচার ছাড়াই এ ভাবে ‘ওদের’ দিকে আঙুল তোলার মধ্যে একটা অভদ্রতা আছে ঠিকই, কিন্তু এই কথাগুলোর মধ্যে কয়েক আনা সত্যও আছে। পরিসংখ্যান বলবে, অতীতেই হোক বা এখন, সবচেয়ে বেশি শিশুজন্মের হার দেখা যায় দরিদ্রদের মধ্যে, গ্রামাঞ্চলে, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিতদের মধ্যে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার সর্বশেষ পর্বের (এনএফএইচএস ৪) পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের গ্রামাঞ্চলে টোটাল ফার্টিলিটি রেট বা টিএফআর (অর্থাৎ, প্রজননক্ষম বয়সে এক জন নারী গড়ে যত সন্তানের জন্ম দেবেন বলে প্রত্যাশিত) হল ২.৪, আর শহরাঞ্চলে এই হার হল ১.৮। কখনও স্কুলে যাননি, এমন মহিলাদের ক্ষেত্রে এই হার হল ৩.১, আর অন্তত ১২ বছর লেখাপড়া করেছেন, এমন মহিলাদের ক্ষেত্রে হার ১.৭। দরিদ্রতম ২০ শতাংশ মহিলার ক্ষেত্রে টিএফআর হল ৩.২, ধনীতম ২০ শতাংশের ক্ষেত্রে ১.৫। তফসিলি জাতিভুক্তদের ক্ষেত্রে এই হার ২.২৬ আর তফসিলি জাতি-জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বাদে এই হার ১.৯৩।

অর্থাৎ, ভারত যদি আজ ‘দুই সন্তান নীতি’র পথে হাঁটে, তবে তার প্রধান লক্ষ্য হবেন গ্রামের মানুষ, দরিদ্র, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত ও সামাজিক ভাবে সবচেয়ে অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ। দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে আমরা কি এমন আচরণই করতে চাই? এটা কি সত্যিই ধরে নেওয়া যায় যে এই অধিক জন্মহারের কারণ হল এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অজ্ঞতা, যুক্তিবোধের অভাব, বা নেহাত কাণ্ডজ্ঞানহীনতা? না কি, তাঁদের জীবনের বিপন্নতাগুলোর কথাও আমাদের ভাবতেই হবে? বহু গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে, এই মানুষদের দারিদ্র, শিক্ষাহীনতা এবং সুযোগের অভাবই তাঁদের অধিকতর সন্তানধারণের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে, কারণ সন্তানই তাঁদের কাছে শ্রেষ্ঠ নিরাপত্তা— বিপদে-আপদে, বৃদ্ধ বয়সে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে, দুর্ভিক্ষে-রাষ্ট্রবিপ্লবে। আমরা কি সেই গবেষণাপত্রগুলো পড়ে দেখব? যে সন্তান সত্যিই জনকল্যাণের কথা ভাবে, তার কর্তব্য কী— এই মানুষগুলোকে কম সন্তান উৎপাদনে বাধ্য করা, না কি তাঁদের আয় বৃদ্ধি করা, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ানো, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে তাঁদের গতিশীল করে তোলা, যাতে যে-কোনও বিপদে সন্তানই তাঁদের প্রধানতম আশ্রয় না হয়?

আর একটি কথা মনে রাখা ভাল— আমরা যে জনগোষ্ঠীর কথা বলছি, সেখানেই কোনও শিশুর বেঁচেবর্তে থেকে বড় হওয়ার পথে বাধাবিপত্তি সবচেয়ে বেশি। ফলে, এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের মনে এই হিসেবটি থাকা স্বাভাবিক যে, অন্তত তিন-চারটি সন্তান জন্মালে, তবে তাদের মধ্যে দুই বা তিন জন বেঁচে থাকবে, বড় হয়ে আশ্রয় দেবে।

এ বার সবচেয়ে গোলমেলে প্রসঙ্গে ঢোকা যাক— এনএফএইচএস ৪-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মুসলমানদের টিএফআর হল ২.৬২, আর হিন্দুদের ২.১৩। মুসলমানদের মধ্যে সন্তান জন্মের হার সত্যিই হিন্দুদের তুলনায় বেশি, কিন্তু একই সঙ্গে কয়েকটা কথা মনে রাখা দরকার। এক, দুই জনগোষ্ঠীর টিএফআর-এ খুব বেশি ফারাক নেই; দুই, ব্যবধান দ্রুত কমছে— মাত্র দশ বছর আগেও, এনএফএইচএস ৩-এ দেখা গিয়েছিল, মুসলমানদের টিএফআর ৩.৪০, আর হিন্দুদের ২.৫৯। অর্থাৎ যে ব্যবধান ছিল মহিলাপ্রতি ০.৮১ সন্তান জন্মের, দশ বছরের ব্যবধানে তা কমে এসেছে ০.৪৯ সন্তান জন্মে। মানে, হিন্দু এবং মুসলমান, দুই জনগোষ্ঠীতেই সন্তান জন্মের হার কমছে, এবং মুসলমানদের মধ্যে কমছে দ্রুততর হারে।

ভারতে সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে মুসলমানেরা যে হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছেন, তা প্রমাণিত সত্য। শুধু বৈষম্য নয়, তার পিছনে আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে— যেমন ধরুন, দেশভাগের সময় বেশির ভাগ সম্পন্ন মুসলমানই পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এই সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবের কথা মাথায় রাখলে, মুসলমানদের মধ্যে সামান্য বেশি টিএফআর-এর পিছনে ধর্মীয় কারণ খোঁজার প্রয়োজন পড়বে না। ধর্মের প্রসঙ্গ যদি আনতেই হয়, তা হলে সেটাকে ‘মাইনরিটি গ্রুপ হাইপোথিসিস’-এর প্রেক্ষিতেই আনতে হবে। এই তত্ত্ব বলে, দুনিয়ার যে কোনও প্রান্তেই সংখ্যালঘুরা— বিশেষত যাঁরা আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে আছেন— নিজেদের অধিকতর বিপন্ন বোধ করেন, এবং সেই বিপন্নতা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটি পরিচিত পথ অধিকতর সন্তানের জন্ম দেওয়া।

ইসলামের সঙ্গে উচ্চ জন্মহারের কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই, পরিসংখ্যানই দ্ব্যর্থহীন ভাবে এই কথাটি জানাবে। ইরান, ইন্দোনেশিয়া বা বাংলাদেশের মতো মুসলমান-প্রধান দেশে গত কয়েক দশকে অত্যন্ত দ্রুত হারে জন্মহার কমেছে। কিন্তু, এ সব কথা কাকে বোঝাবেন! মাঝেমধ্যেই শুনবেন, হয় কোনও নেতা, নয় কোনও বন্ধু বা আত্মীয় আপনাকে বুঝিয়ে বলছেন, কী ভাবে মুসলমানেরা চড়া জন্মহার বজায় রেখে অচিরেই জনসংখ্যায় হিন্দুদের টপকে যাবে। এবং, তাঁরা বলবেন যে মুসলমানদের এই বেলাগাম সন্তান উৎপাদনের প্রবণতা ঠেকানো দরকার। এই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবিটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁরা শোনাবেন, প্রত্যেকটা মুসলমান পুরুষের চারটে বৌ— সন্তানসংখ্যা তো বেশি হবেই; অথবা বলবেন, দাঙ্গা-পরবর্তী মুসলমান শরণার্থী শিবিরগুলো তো সন্তান উৎপাদনের কারখানা হয়ে উঠেছে (এই কথাটা কে বলেছিলেন, আমাদের এখনও মনে আছে, তাই না?)।

স্পষ্টতই, দেশের ওপর ‘দুই সন্তান নীতি’ যদি চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার শিকার হবেন দেশের দুর্বলতম জনগোষ্ঠী— দরিদ্রেরা, গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা, অল্পশিক্ষিতেরা, এবং দেশে যে-ভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আর ধর্মান্ধতা বেড়ে চলেছে, তাতে অতি অবশ্যই মুসলমানেরা। অধিকতর সন্তানের জন্ম দেওয়ার পিছনে তাঁদের নিজস্ব অকাট্য যুক্তি রয়েছে, এই কথাটা যদি বাদও দিই, ‘দুই সন্তান নীতি’ গ্রহণ করা হলে এই জনগোষ্ঠীর ওপর জোরজুলুম, অন্যায় শাস্তির প্রবণতা বাড়বে এবং তাঁদের উদ্দেশে বিদ্বেষপূর্ণ কথাও বাড়বে। মনে রাখা প্রয়োজন, এই রাষ্ট্রীয় গা-জোয়ারির বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা এই জনগোষ্ঠীরই সবচেয়ে কম। জরুরি অবস্থার সময়কার জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতির বীভৎসতার কথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন। জবরদস্তি জন্মনিয়ন্ত্রণের নীতির সবচেয়ে বড় শিকার মহিলারা, এটাও ভুললে চলবে না।

চিনে ‘এক সন্তান নীতি’র কী বিষময় ফল হয়েছে, সেটাও মনে রাখতে হবে। প্রসঙ্গত, চিন এখন জন্মহার বৃদ্ধির পথে হাঁটতে চাইছে। কারণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতির ফলে সে দেশে মোট জনসংখ্যায় বয়স্ক মানুষের অনুপাত উন্নত দেশগুলোর স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু, সেই বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ভরণপোষণের জন্য যে-আয় প্রয়োজন, চিন সেখানে পৌঁছতে পারেনি। সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চিন্তাভাবনাহীন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি কতখানি মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা একটা অন্য লেখার বিষয়।

কর্নেল ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement