মাসরাত জেহরা
কাশ্মীরের চিত্রসাংবাদিক মাসরাত জ়াহরার বিরুদ্ধে ‘আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ় প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ (ইউএপিএ)-এর অধীনে অভিযোগ আনা হইয়াছে। কারণ, তিনি সমাজমাধ্যমে একটি ছবি দিয়াছিলেন। জ়াহরার তোলা ছবি দেশবিদেশের বহু সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়, এই ছবিটিও দুই বৎসর আগে এক পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল। ছবিতে দেখা যাইতেছে, মহরমের দিন হিজবুল মুজাহিদিন গোষ্ঠীর এক নিহত কম্যান্ডারের পোস্টার লইয়া কিছু মানুষ রাস্তায় নামিয়াছেন, পোস্টারে নেতাকে ‘শহিদ’ বলা হইয়াছে। জ়াহরা সমাজমাধ্যমে পূর্বপ্রকাশিত খবরটির সম্পূর্ণ চিত্রপরিচিতি দিয়াছিলেন, শুধু ‘শহিদ’ শব্দে উদ্ধৃতিচিহ্ন দেন নাই। ফল, তাঁহাকে ফোন করিয়া অবিলম্বে শ্রীনগরের থানায় আসিতে বলা হইল। লকডাউনে বাহির হইবার ‘কারফিউ পাস’ না থাকায় জ়াহরা থানায় যান নাই, তৎক্ষণাৎ কাশ্মীর প্রেস ক্লাবের অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের সহিত যোগাযোগ করেন। সহকর্মীদের তৎপর প্রচেষ্টায় তাঁহাকে পুলিশ আর ফোন করে নাই সত্য, কিন্তু উদ্বিগ্ন জ়াহরা পরে জানিতে পারেন, তিনি ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত, এমনকি তাঁহার বিরুদ্ধে এফআইআর-ও করা হইয়া গিয়াছিল।
শুধু উদ্বেগ নহে, ইহা আতঙ্কেরও কারণ। মনে রাখিতে হইবে, ইউএপিএ একটি অতি কঠোর আইন, যাহার বলে নাগরিক মাত্রেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ ও ‘দেশদ্রোহী’ বলিয়া চিহ্নিত হইতে পারেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত কারাবন্দি হইতে পারেন। এহ বাহ্য, পুলিশি হেফাজতে হেনস্থা ও অত্যাচারের কথা না বলাই ভাল। লকডাউনে গৃহবন্দি এক প্রতিষ্ঠিত, অভিজ্ঞ চিত্রসাংবাদিক সমাজমাধ্যমে পূর্বপ্রকাশিত একটি ছবি পোস্ট করিয়া যদি জনতাকে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গে উস্কানি দিবার, রাষ্ট্রবিরোধিতাকে গৌরবান্বিত করিবার দায়ে অভিযুক্ত হন, তাহা হইলে ভারতের নাগরিক অধিকারের অবস্থা কোথায় নামিয়া আসিয়াছে, তাহা ভাবিতেও শঙ্কা ও ত্রাস উপস্থিত হয়।
সারা দেশ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়িতেছে, কিন্তু এমন জাতীয় সঙ্কটকালেও নরেন্দ্র মোদী চরিত্র কিছুমাত্র পাল্টায় নাই। কথায় কথায় তাঁহারা দেশদ্রোহের অভিযোগ আনিতেছেন, সরকারের অপছন্দসই কাজ করিলে তাহাকে কঠিন অভিযোগের ভিত্তিতে দণ্ডনীয় সাব্যস্ত করিতেছেন। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে দেশবাসী যখন জবুথবু, সেই অবকাশে এক দিকে জেএনইউ-এর উমর খালিদ কিংবা দক্ষিণ ভারতীয় সমাজকর্মী-লেখক তেলতুম্বডের বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টিন্যাশনালিস্ট’ কার্যকলাপের পুরাতন মামলায় নূতন করিয়া শান পড়িতেছে, অন্য দিকে নূতন মামলায় সাংবাদিকের হেনস্তা হইতেছে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মতপ্রকাশের অধিকার, এহেন শব্দগুলি ক্রমশই এই দেশে সুদূরপরাহত। এবং এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য যত ভাবে পারা যায় কৌশল অবলম্বন করিতেও কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিধা নাই। প্রসঙ্গত, পুলিশ সন্তর্পণে জ়াহরার সাংবাদিক পরিচয়টি সরাইয়া কার্য সমাধা করিতে চাহিয়াছিল। অভিযোগপত্রে তাঁহার পরিচিতি লেখা হইয়াছে ‘সমাজমাধ্যম-ব্যবহারকারী’। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে দেশের সাংবাদিক মহল হইতে বিবৃতি গিয়াছে। এখনই ইহার প্রতিকারের দাবি উঠিয়াছে। জ়াহরার সংবাদ ভারতীয় নাগরিক সমাজকে নূতন ভাবে উদ্বিগ্ন করিতেছে।