দার্শনিক রেনে ডেকার্ত বলেছিলেন, আমি চিন্তা করি, কাজেই আমি আছি। আর আমি ভাবতে বসে দেখি, চিন্তার জগৎ কখনও ধূসর হয়ে যায়, কখনও অদ্ভুত আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একই মানুষের ভিতর যেন দ্বিতীয় আর এক মানুষ। এটাই কি সেই দ্বৈত সত্তা? বিজ্ঞানের ভাষায়, বাইপোলার ডিজ়অর্ডার! এর কারণেই কি ভার্জিনিয়া উলফের মতো মহান লেখিকা আত্মহত্যা করেন?
এই দু’রকম পৃথিবীর সহ-অবস্থান বারবার গুলিয়ে দেয় আমাদের। কখনও তুমুল উৎসব-আসরেও এক তমসাঘন বিষণ্ণতা পূর্ণগ্রাস গ্রহণের মতো ছেয়ে ফেলে। বুকের ভেতর থেকে দুমড়ে, মুচড়ে ঠিকরে আসে কান্না। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাই সব কিছু থেকে। আচ্ছা, ঋত্বিক ঘটকের মতো মানুষকেও তো কিছু দিন কাটাতে হয়েছিল গোবরা মানসিক হাসপাতালে, তাঁরও কি এমনই মনে হত? আবার যখন ভেতরকার আনন্দরস পাক খায়, মৌতাতের ভিয়েন বসে, রস ঘন হয়, তখন অন্ধকারেও জেগে ওঠে জ্যোতির্বলয়। কী তার উন্মাদনা! ঠা-ঠা রোদ্দুরেও মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বিড়বিড় করে যেতে ইচ্ছা করে— যে খায় চিনি, তারে জোগায় চিন্তামণি। এমনটাই কি হয়েছিল শ্রীচৈতন্যের শেষ জীবনে! এই কি তুরীয় আনন্দ?
বেঁচে থাকার মতো ভীষণ ঠাট্টা কখনও যেন হয়ে যায় ভারী বোঝা। আর টানতে পারি না। প্রতি মুহূর্তে মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছি। রাগ, দুঃখ, ঘেন্না, প্রতিশোধ-স্পৃহা সব মিলেমিশে চিৎকার হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দলাপাকানো জীবনটাকে নিয়ে দুমড়ে, মুচড়ে আছড়ে ফেলে, ছেনে-ছিঁচে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছা করছে। এত অসহায় কেন আমি! আমারই দু’পায়ে পরানো কেন সেই অদৃশ্য শিকল। সেই সব সময়ে মনে হয়, এই শিকল থেকে মুক্তির কি একটাই উপায়, যার নাম মৃত্যু? যেমনটা ঘটিয়েছিলেন ভ্যান গখ, যিনি কিনা ছিলেন ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রকলার পুরোধা। আবার রুটি বেলতে বেলতে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে যখন দেখলাম, ওই যে গাছটার ডালে কৃষ্ণঠাকুর বসে। বাঁশি বাজাচ্ছে। স্পষ্ট শুনলাম সে বাঁশি। মীরারও কি হয়েছিল এমনটা?
আর কেউ শোনে না, আমি বাঁশি শুনি। খাতার সাদা পৃষ্ঠাগুলোয় আমি দেখতে পাই কালো কালো অক্ষরমালার বিন্যাস। অথচ আর সকলে বলছে সেখানে কোনও লেখাই নাকি নেই। বুঝি, সবটাই আছে। আমাদের ভেতরেই ঘাঁটি গেড়ে, আত্মঘাতী বোমারু জ্যাকেট পরে চুপটি করে ঘাপটি মেরে আছে। এই তবে ভাবের ঘরে ভবের চুরি। আত্মঘাতী বিস্ফোরণই বটে। আমি চলি, সে-ও চলে। আবার কখনও সে চলে, আমি স্থির। কখনও দু’জনেই চলি। আবার কখনও বা দু’জনেই স্থির। স্থাণুবৎ। অনন্তকাল পার হয়ে যায়। আর কে যেন আমার কানের কাছে গুনগুন করে গেয়ে ওঠে... ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা! ও মন জানো না। জানো না।’
বিজ্ঞান বলে, মন আসলে রসায়ন। মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও ডোপামিন হরমোনের অস্বাভাবিক ক্ষরণে অবসাদগ্রস্ততা বা অতিচাঞ্চল্য মানুষকে এক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তা না-হয় বুঝলাম, কিন্তু আমি যে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না নিজেকে। চিৎকার করে, ভেঙেচুরে, এমনকি গোলাপের পাপড়িগুলোও কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। কাছের মানুষ কচুরিপানা সরানোর মতো দূরে ঠেলে দিতে চায়। ওই তো কে যেন বলছে, ‘দাও না দু’ঘা কষিয়ে। ঠিক সাইজ হয়ে যাবে।’ মেরো না, বড্ড লাগে। কত মানুষ যে এমন যন্ত্রণা সয়ে বেঁচে আছে।
চোখে কালোশিরার অসুখ/ কানে যেই বধিরতা আছে/ যেই কুঁজ— গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে/ নষ্ট শসা— পচা চালকুমড়ার ছাঁচে/ যে সব হৃদয়ে ফলিয়াছে—/ সেই সব। এ কি কবি জীবনানন্দ দাশের একার বিপন্নতা, নাকি সামাজিক ভাবে বিপজ্জনক এক অস্তিত্ব! মিশেল ফুকো দেখিয়েছেন, কেন ‘পাগল’-কে সবার থেকে দূরে সরিয়ে উন্মাদাগারের মধ্যে বেঁধে রাখা হয়। তিনি এক এমন দার্শনিক, যিনি ‘পাগল কে?’ তা বুঝতে গিয়ে তাঁর দিকে আঙুল-তোলা সমাজকেই বিশ্লেষণ করেছিলেন।
এখন মানসিক রোগ সম্পর্কে অনেক বেশি কথা হচ্ছে আগের থেকে। সমাজে তথা পরিবারের কাছে এই মানসিক অসুখগুলো এখন আর লুকোছাপা করার জায়গা নেই। কিন্তু ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেতে বললেই কি দায় সারা হয়? যে ধৈর্য, সহমর্মিতার কাঙাল এই মানুষগুলো, তা মেলে কই? যাঁদের মনটা পাঁচ জনের চাইতে অন্য রকম, তাঁদের ভেতরে বিকৃতি না খুঁজে তাঁদের যন্ত্রণাকে বুঝতে চায় ক’জন?
এত দিনে হাত-পা বেঁধে ‘এই পাগল, এই পাগলি’ বলে উপহাস করা যে মানুষের কাজ নয়, সে সম্পর্কে একটু বোধ হয়তো তৈরি হয়েছে। কিন্তু আইন করে উত্ত্যক্তকারীকে সাজা দিলেই কাজ শেষ হয় না। এই অবুঝ, অসহায় মানুষগুলোর সমস্যাকে বোঝানোর জন্য গণমাধ্যমের সহায়তা একান্ত জরুরি। নাটক, চলচ্চিত্র, সাহিত্য হয়তো সেই কাজটা করতে পারে।