ভূগর্ভস্থ জলে টান পড়েছে। আজ মানুষ-সহ সমস্ত জীবজগৎ এক গভীর অস্তিত্বের সঙ্কটে। বিশ্ব-উষ্ণায়ন ও তজ্জনিত জলবায়ুর পরিবর্তন এই সঙ্কটের কারণ। বিজ্ঞানীদের মতে, ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি আসতে আর দেরি নেই। কিন্তু এই সাবধানবাণী বিশ্বের ক’টি দেশ মানছেন? বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্ব-উষ্ণায়নের জন্য মূলত দায়ী পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ। আর তার সর্বাধিক কুপ্রভাব পড়ছে দরিদ্র ও অনুন্নত দেশগুলির উপরে। আর সেই সব দেশের আমজনতার ঘরে আজ হাহাকার উঠছে— জল নেই, জল নেই। সম্প্রতি ‘নীতি আয়োগ’এর সতর্ক বাণী— ভারতের প্রধান শহরগুলি ২০২০ সাল থেকে জলশূন্য হয়ে পড়বে। অর্থাৎ, ভূগর্ভস্থ জল শূন্য হয়ে যাবে। এর প্রতিবিধানের জন্য সরকারের আগামী কার্যক্রম কী হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত প্রতীক্ষায় আছে আমজনতা।
আমাদের দেশে সব চেয়ে বেশি পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল খরচ হয় কৃষিকাজে। ষাটের দশকের আগে অবস্থাটা এমন ছিল না। যখন এর গোড়াপত্তন হয় এ দেশে হাইব্রিড ধান-গমের চাষ শুরু হয়েছিল। সাধারণ ভাবে জনসাধারণ শুনে আসছে— ভারতে কৃষি ব্যবস্থা উন্নত মানের নয়। কৃষিনীতি পাল্টানো দরকার। আবার, বাম আমলে জেনেছি, ভারতে খাদ্য-সমস্যার কারণ উৎপাদনের ঘাটতি নয়, মূল কারণ— ‘ম্যাল ডিস্ট্রিবিউশন’ বা বিতরণ ব্যবস্থায় অসঙ্গতি। এ ছাড়া তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শাসক দল প্রচার করত, বর্ধিত জনসংখ্যাই ভারতের খাদ্যাভাবের মূল কারণ। তবুও খরা বা খাদ্যাভাবের কারণে প্রান্তিক এলাকার দরিদ্র মানুষদের মধ্যে অনাহারে মৃত্যু কম ছিল। কারণ, গ্রামের মানুষ তখন নিজেদের এলাকায় সহজপ্রাপ্য প্রাকৃতিক বীজ ও উদ্ভিদের চাষ করেছে।
এর পর যখন এল রাসায়নিক সার, একফসলি বীজ, এল কীটনাশকের বাজার তখন ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যক দেশে অন্নসংস্থানের জন্য এ সবের বিপুল ব্যবহার চলতে লাগল। হাইব্রিড ধান-গম ফলাতে যে পরিমাণ জল লাগে তা চাষি শ্যালো পাম্প ব্যবহার করে রাত্রি-দিন তুলতে লাগল। জলের ভান্ডার সম্পর্কে আগাম কোনও সতর্ক বার্তা দেওয়ার প্রয়োজনও পড়েনি তখন। এক-দুই ফসলি জমি তখন হয়ে গেল চার ফসলি। এতে চাষিরা কতটা লাভবান হল তার চেয়ে বড় কথা, সুদিনের মুখ দেখল ফড়ে-দালালেরা। প্রযুক্তির উন্নয়নে চাষি পেল এক-ফসলি বীজের আর্থিক বোঝা, রুক্ষ-ঊষর-অনুর্বর মাটির জন্য উন্নত প্রযুক্তির সার কেনার আর্থিক বোঝা, মৃত নদী আর শূন্য হতে বসা জলের ভাণ্ডার।
আজ বিশ্ব-উষ্ণায়নে আমরা শঙ্কিত। এই বিশ্ব-উষ্ণতা বৃদ্ধিকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার ২ ডিগ্রি (চেষ্টা ছিল ১.৫ ডিগ্রি) উপরে সীমিত রাখার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে। সেই চুক্তিতে ২০২৫ সালের মধ্যে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা ২৬-২৮ শতাংশ হ্রাস করার অঙ্গীকার করেছিল মার্কিন সরকার। একই সঙ্গে শপথ নেওয়া হয়েছিল তাপ বিদ্যুতের ক্ষেত্রে রাশ টানতেও। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ওই নিয়ন্ত্রণ তিন বছর আগেই বাতিল করে দিয়েছেন।
বিজ্ঞানীদের সাবধানবাণী বর্তমান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মানেননি। তিনি জানিয়েছেন, প্যারিস চুক্তি শুধু চিন আর ভারতকে সাহায্য করবে। ওঁর মতে, প্যারিস চুক্তি আমেরিকার অর্থনীতিকে ধ্বংস করবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ তাঁর কাছে সবার আগে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল তিনি দাবি করেছিলেন, ওই চুক্তি থেকে চিন ও ভারত লাভবান হবে। অথচ, প্যারিস চুক্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল— গরিব দেশগুলিকে অর্থ সাহায্য দেবে আমেরিকা-সহ প্রথম বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলি। এর মাঝে আমেরিকার ৩০০ কোটি ডলারের অনুদান দেওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে। এই অনুদানের ১০০ কোটি ডলার দেওয়া হয়ে গিয়েছে বারাক ওবামার জমানাতেই। কিন্তু বাকি অনুদান দিতে এখন অস্বীকার করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও আমেরিকা আজ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ১৫ শতাংশ জোগান দেয়, তবুও মার্কিন সিদ্ধান্ত পৃথিবীকে নিশ্চিত ভাবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস tipping point-এ নিয়ে যাবে এবং পৃথিবীর জীবজগৎকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে আসবে।
জলবায়ুর পরিবর্তন যে মারাত্মক আকার ধারণ করতে চলেছে, তার সতর্ক বার্তা পেয়েও আমরা কতটা সচেতন? বিশ্বের জলবায়ুর স্থায়িত্বের জন্য উত্তর মেরুর বরফের এক বিরাট ভূমিকা আছে। সাদা বরফ সূর্যরশ্মিকে প্রতিফলিত করে, একে অলবিদ এফেক্ট বলে। উত্তর মেরুতে সমুদ্রের বরফ গলে গেলে যে ‘কালো সমুদ্রে’র সৃষ্টি হয়, তা সূর্য-রশ্মিকে শোষণ করে তাপ বাড়ায়। জানা যায়, ২০১৬ সালের পুরনো রেকর্ডের তুলনায় উত্তর মেরুর বরফের পরিমাণ এই দ্বিতীয় বার সব চেয়ে বেশি কমে গিয়েছে। অন্য দিকে, গ্রিনল্যান্ডের বরফের স্তূপ ক্রমান্বয়ে দ্রুত গলে যাওয়ার ফলে সমুদ্রতল আরও উঠে যায়।
স্টক হোল্ম এনভায়রনমেন্ট ইনস্টিটিউট ২০১৬ সালে যে রিপোর্ট বার করে, তাতে জানা যায়, ওই সময়ে যে তাপমাত্রা দেখা যেত, তার চেয়ে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছে। আবার, তুন্দ্রা অঞ্চলের বরফ গলে গেলে বরফের স্তূপের নীচে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমে থাকা মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসবে, যা বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে বহুগুণ বেশি। ফলে, বিশ্বের উষ্ণতা বহুগুণ বেড়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ত্বরান্বিত করবে। এ দিকে বিশ্ব-উষ্ণায়ন শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাবে তাই নয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়েরও কারণ হবে। শুধু মাত্র উষ্ণায়নের কারণে সারা বিশ্বে সম্মিলিত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২,৪০,০০০ কোটি মার্কিন ডলার।
খবরে প্রকাশ, দ্য ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্ব জুড়ে সর্ব মোট কাজের সময় কমবে বছরে দুই শতাংশেরও বেশি। হয় অত্যধিক গরমে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে অথবা এনার্জি লেভেল কমে গিয়ে মানুষের কাজের গতি হ্রাস পাবে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা এর প্রভাবে সব চেয়ে ক্ষতি হবে ভারতের। বিশেষ করে, কৃষি ক্ষেত্র ও নির্মাণ শিল্প সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই তাপজনিত কারণে মানুষের অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কাকেও মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবে জল নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা মাথায় রেখে কেন্দ্রীয় সরকার ‘জলশক্তি’ অভিযান শুরু করেছেন। দেশের ২৫৬টি জেলায় জল সংরক্ষণ নিয়ে প্রচার চলবে। তবে এমনটা নয় যে, দেশের সর্বত্রই ভূগর্ভস্থ জলে টান রয়েছে। আসলে ভূগর্ভস্থ জল যতটা তোলা হচ্ছে, ততটা জল সঞ্চিত হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রক জলের অপচয় বন্ধ করতে এই প্রচারকে এক গণ আন্দোলনের রূপ দিতে মনস্থ করেছে।
জলের অপচয় রোধে মানুষের অভ্যাস বদলাতে হবে। ১৯৫১ সালে বছরে মাথাপিছু ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণ ছিল ৫,১৭৭ ঘনমিটার, যা ২০১১ সালে নেমে এসেছে ১,৫৪৫ ঘনমিটারে। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, বুন্দেলখন্দ সহ দেশের বড় অংশে জলের সমস্যাকে জাতীয় দুশ্চিন্তার বিষয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক