প্রতিবাদ : মুখ্যমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর এসএসকেএম-এ চিকিৎসকদের অবস্থান বিক্ষোভ। বৃহস্পতিবার ১৩ জুন, ২০১৯। ছবি: সুমন বল্লভ
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক আর রোগীর পরিজনদের মধ্যে অবিশ্বাস না থাকাই বুঝি অস্বাভাবিক। এমন দাবি কেন করছি, একাধিক প্রসঙ্গ ধরে তার ব্যাখ্যা সম্ভব। সব কিছুই নিখরচায় পাওয়া যাবে, মুখ্যমন্ত্রীর এই আশ্বাসের পরও কেন রাস্তা পেরিয়ে উল্টো দিকের দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনতে হয়; একটা এক্সরে করানোর জন্য, ল্যাব থেকে রিপোর্ট নেওয়ার জন্য কেন পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে হয় গোটা হাসপাতাল চত্বরে; ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীরা কেন অসম্ভব খারাপ ব্যবহার করেন বেশির ভাগ সময়— সবই অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। এই লেখায় একটা অন্য প্রসঙ্গ ধরে সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করব। ধরুন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন কেউ। তাঁর বাড়ির লোকের সন্দেহ হল, চিকিৎসকের গাফিলতিতেই মারা গিয়েছেন তিনি। প্রায় সব অশান্তির প্রাণকেন্দ্রে থাকে সেই সন্দেহ।
সে সন্দেহ নিরসনের উপায় আছে কি? খোঁজ করলে দেখবেন, উপায়গুলো এ রকম— প্রথমে হাসপাতালের সুপারের কাছে অভিযোগ; তাতে কাজ না হলে ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলের কাছে; সেখানেও ফল না হলে দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল কাউন্সিলে যাওয়া যায়; যেতে পারেন আদালতে, বা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতেও। কিন্তু, সে পথে হেঁটে কি সত্যিই সুরাহা হয়? রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যসচিব দিলীপ ঘোষ বললেন, ‘‘আমার স্ত্রীর অস্ত্রোপচার করেছিলেন আমার এক বিশিষ্ট ডাক্তার-বন্ধু। একটা বেসরকারি হাসপাতালে, যদিও। স্ত্রী মারা গেলেন সেই অপারেশনের কয়েক দিন পর। আমার বন্ধু জানালেন, তাঁর এক জুনিয়রের অবহেলায় মৃত্যু। তিনি আমায় বহু দূর সাহায্য করলেন, কিন্তু আমিও পারিনি সেই ডাক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করতে। এই ক্ষেত্রে পুরো জিনিসটাই এমন ভাবে ডাক্তারদের হাতে যে তাঁরা যদি কোনও সহকর্মীর দোষ আড়াল করতে চান, তা হলে সেই দোষ প্রমাণ করা কার্যত অসম্ভব।’’ যে কাজ আমলারও সাধ্যের অতীত, সাধারণ মানুষ সে কাজ পারবেন, ভরসা করা চলে?
সরকারি হাসপাতালে কোনও রোগী চিকিৎসকের গাফিলতিতে মারা গেলেন কি না, জানার উপায় আছে? বাড়ির লোককে যদি না-ও জানানো হয়, হাসপাতালের সুপার কি জানতে পারেন, কোনও জুনিয়র ডাক্তারের গাফিলতিতেই মারা গেলেন কি না কোনও রোগী? দিলীপবাবু বললেন, ‘‘মেডিক্যাল অডিট যাকে বলে, সরকারি হাসপাতালে সেটা হয় বলে আমার জানা নেই। একমাত্র প্রসূতিমৃত্যু বা সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যু হলে নিজে থেকে তদন্ত হয়, অন্য কোনও ক্ষেত্রে নয়।’’ কলকাতার এক সরকারি হাসপাতালের শিক্ষক-চিকিৎসকও স্বীকার করলেন, সিএমসি, এমস বা চণ্ডীগড়ের পিজিআই-তে যে ভাবে মেডিক্যাল অডিট হয়, পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালগুলোয় তার কিছুই হয় না। ফলে, কোনও ডাক্তারের গাফিলতি ছিল কি না, তদন্ত কমিটি না বসলে তা ধরা পড়ার সম্ভাবনা নেই।
সরকারি হাসপাতাল কী ভাবে চলে, সে বিষয়ে কোনও অভিজ্ঞতা আছে আপনার? আমার প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন করলেন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ কুণাল সরকার। ‘‘সেখানে মেডিক্যাল রিপোর্ট থাকে, যে অডিট হবে? হাসপাতালের পক্ষেও বলার মতো কথা আছে— এই ভিড় সামলাতে যত জন ডাক্তার দরকার, তার এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে কাজ চলছে।’’ কিন্তু, মোদ্দা কথাটা তা হলে কী দাঁড়াল— কোনও ডাক্তারের ভুলে অথবা অবহেলায় রোগী মারা গেলেন কি না, পরিজনের পক্ষে সে কথা জানার কোনও উপায় নেই, এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অন্ধকারেই থাকেন? এই কথাটা ডাক্তাররাও নিশ্চয় জানেন— ভুল করলেও ধরা পড়ার, শাস্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, অথবা নিতান্ত ক্ষীণ।
পশ্চিমবঙ্গের কোনও হাসপাতালের এক জন চিকিৎসকও স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে অবহেলা করে কোনও রোগীর মৃত্যু ঘটান, এমন কথা বলার কোনও প্রশ্নই নেই। কারও দিকে অভিযোগের আঙুল তোলার জন্যও এই লেখা নয়। কিন্তু, তথ্যের অসমতা বড় মারাত্মক জিনিস। শুধু ডাক্তার বলে নয়, যে কোনও লোকই যদি জানেন যে ভুল করলে শাস্তি হবে না, তবে তাঁর অসতর্ক থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। গাড়ির ইনশিয়োরেন্স থেকে যদি ক্ষতি হওয়া টাকার পুরোটাই পাওয়া যায়, তাতে যেমন চালকদের অসাবধানতার মাত্রা বাড়ে। অর্থনীতির তত্ত্বে এই সমস্যাটার নাম মর্যাল হ্যাজ়ার্ড। এই মর্যাল হ্যাজ়ার্ডের খপ্পর থেকে বাঁচার পথ ডাক্তারদেরও নেই। ধরা পড়ার সম্ভাবনা না থাকলে তাঁদের অসাবধানতাও বাড়বে।
বলতেই পারেন, গাড়ি লক করতে ভুলে যাওয়া আর চিকিৎসায় অসাবধান হওয়া ঠিক এক কথা নয়। চিকিৎসকের এথিক্স— নৈতিকতার বোধ— তাতেই আটকে যাবে এই অসাবধানতা। আজ থেকে কয়েক দশক আগে, চিকিৎসা যখন ক্রেতা সুরক্ষার আওতায় আসেনি, তখন শুধু চিকিৎসকের নৈতিকতার ভরসাতেই মানুষ হাসপাতালে যেতেন, বেঁচে ফিরতেনও বটে। আজ তা হলে সেই নৈতিকতাকে ভরসা করা যাবে না কেন? আবারও বলি, কোনও চিকিৎসকের নৈতিকতাকে সন্দেহ করছি না— অভিজ্ঞতায় জানি, বহু ডাক্তারের ক্ষেত্রেই ‘দেবতুল্য’র মতো সুপ্রযুক্ত বিশেষণ আর হয় না। তবুও, দুটো কথা থেকে যায়। এক, পরিবর্তনের ছাপ অনপনেয়। যে বাজার এক বার বদলে যায়, তাতে আর পুরনো নিয়ম খাটে না। যে চিকিৎসার বাজারে ক্রেতা সুরক্ষার ধারণা এক বার ঢুকে পড়েছে, ডাক্তার আর রোগীর সম্পর্কের ওপর ফৌজদারি মামলার ছায়া পড়েছে, সেই বাজারে আর পুরনো নৈতিকতায় ততখানি ভরসা করা মুশকিল। ডাক্তাররাও পাল্টেছেন, রোগীরাও। আর দ্বিতীয় কথা, যে কথাটা আরও জোর দিয়ে বলার, তা হল, প্রশ্ন যেখানে জীবনমৃত্যুর, সেখানে নৈতিকতার কাঁধে এতখানি ভার চাপিয়ে দেওয়া বিপজ্জনক। ডাক্তাররা নিশ্চয় তাঁদের নৈতিকতার বোধেই চালিত হবেন, নিশ্চয় চেষ্টা করবেন প্রতিটি রোগীর জীবন বাঁচানোর, কিন্তু তার পরও যদি একটা কাঠামোগত নজরদারির ব্যবস্থা থাকে, তবে নিশ্চিন্ত হওয়া সহজ।
এতে ডাক্তারদেরও আপত্তি থাকার কথা নয়। নিশ্চিত জানি, বেশির ভাগ ডাক্তারই অত্যন্ত দায়িত্বশীল। টানা ত্রিশ ঘণ্টা ডিউটির ধকল সহ্য করেও প্রাণপণ চেষ্টা করে যান রোগীদের সুস্থ করে তোলার। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিয়োতে দেখছিলাম, মেডিক্যাল কলেজে দাঁড়িয়ে এক মধ্যবয়স্ক মহিলা— গ্রামের বধূ, সম্ভবত মুসলমান— বলছেন, ডাক্তাররা তাঁদের বলেন, ‘মা, চোখে জল নিয়ে এখানে আসেন, ফেরার সময় আপনাদের হাসিমুখটুকু দেখতে চাই’। দু’এক জন দায়িত্ববোধহীন ডাক্তারের জন্য তাঁদের সবার বদনাম হবে কেন? তার চেয়ে কি এমন একটা ব্যবস্থা ভাল নয়, যেখানে সেই দু’এক জনকে আলাদা করে ছেঁকে ফেলা যাবে, আর সেই কথা জানতে পারবে সাধারণ মানুষ? বাকিদের সম্বন্ধে রোগীরা নিশ্চিত হতে পারবেন যে এই ডাক্তারবাবুর হাতে রোগীর দায়িত্ব দিলে আর ভাবতে হবে না? এই ছাঁকনি যেমন রোগীদের স্বার্থে, তারও বেশি সৎ ডাক্তারদের স্বার্থে।
সেই ছাঁকনিটুকুর ব্যবস্থা করা যায় না কেন? কুণালবাবু বললেন, ‘‘এই রাজ্যের একটাও সরকারি হাসপাতাল, এমনকি এসএসকেএম-ও, এনএবিএইচ (ন্যাশনাল অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ড ফর হসপিটালস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রভাইডার্স)-এর শর্ত পূরণ করতে পারবে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সেই অ্যাক্রেডিটেশন নিতে হয়, সরকারি হাসপাতালকে হয় না। ফাঁক তো নিয়মেই রাখা আছে।’’ হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট বিশেষজ্ঞদের হাতে ছাড়া হোক সরকারি হাসপাতালগুলি পরিচালনার ভার, নজরদারির দায়িত্ব, পরামর্শ তাঁর।
পরিকাঠামোয়, ডাক্তার-সংখ্যায় না হয় ফাঁক থাকলই। কিন্তু, অডিট করতে কি সব রোগীর সব নথি পরীক্ষা করতে হয়? বেছে নেওয়া যায় না কিছু মৃত্যুর ঘটনা, খুঁটিয়ে পরীক্ষা হবে যার চিকিৎসাপদ্ধতির? সেই অডিটের দায়িত্ব থাকতে পারে না ব্যবস্থার বাইরে থাকা, প্রত্যক্ষ স্বার্থহীন, বিশেষজ্ঞদের ওপর? তা হলে, ডাক্তাররা অন্তত এটুকু জানতেন, তাঁদের গাফিলতিতে, চিকিৎসার ভুলে যদি মৃত্যু হয় কারও, সেই ত্রুটি ধরা পড়ে যেতে পারে। গাফিলতির গুরুত্ব বুঝে শাস্তি হতে পারে। ডাক্তারদের মাথায় শাস্তির খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখলে তাঁরা আর ঝুঁকি নেবেন না, ফলে যেখানে চিকিৎসক একটু সাহস করলে রোগীর প্রাণ বাঁচাতে পারতেন, তেমন ক্ষেত্রে তাঁরা সাবধানী হলে শেষ অবধি রোগীর ক্ষতি হবে, এই যুক্তিটা পরিচিত। সত্যিও বটে। কিন্তু, যুক্তিসঙ্গত ঝুঁকি আর অকারণ অবহেলার মধ্যে ফারাক করা অসম্ভব, এমনটাও কি দাবি করা যায়?
বিশ্বাসের অভাবেই রাজ্যের হাসপাতালগুলো আজ রণক্ষেত্র হয়েছে। সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারলে সবচেয়ে লাভ ডাক্তারদেরই।