পুনরুজ্জীবন

এই নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গিটি কঠোর ভাবে সত্য, কিন্তু একমাত্র সত্য নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

প্রচলিত বিশ্বাসে ক্রুশবিদ্ধ হইবার পর জিশু খ্রিস্ট প্রয়াত হন নাই, দেবতারূপে নূতন করিয়া জন্ম লইয়াছিলেন। ঘটনার নাম পুনরুজ্জীবন। বিশ্বাস লইয়া আলোচনা নহে, জরুরি উহার নৈতিক সারটি। কাহাকেও হত্যা করিলেই মুছিয়া ফেলা যায় না, বরং কখনও তাহা আরও অধিক জীবন্ত ও প্রাণবন্ত হইয়া উঠিতে পারে। যেমন বর্তমান ভারতে ‘সংবিধান’ বস্তুটি ক্রমশ মহার্ঘ হইয়া উঠিতেছে। এই শুষ্কং কাষ্ঠং শব্দটি এত দূর জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছে যে ২০১৯ সালের ‘অক্সফোর্ড হিন্দি ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ ঘোষিত হইয়াছে। যাঁহারা কখনও সংবিধান পড়েন নাই, কিংবা সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত ছিলেন না, তাঁহারাও আজ উহা তুলিয়া ধরিতেছেন। কিন্তু কোন জাদুমন্ত্র বলে নবজন্ম লাভ করিল ‘সংবিধান’? জবাবটি প্রাথমিক ভাবে নঞর্থক। ভারতের সংবিধান মানবদেহের অস্থিসদৃশ কল্পনা করিলে বুঝা যাইবে, সাধারণ অবস্থায় উহা চোখে পড়ে না, কিন্তু কোথাও ভাঙিলে বা চিড় ধরিলে অভূতপূর্ব বেদনা বোধ হয়। ভারতীয় জনতা যে রূপে সংবিধানকে আশ্রয় করিতেছেন, তাহাতে অনুমান করা চলে যে ভারত নামক রাষ্ট্রের কাঠামোটি নানা ভাবে বিপন্ন হইয়াছে। কিয়ৎকাল পূর্ব অবধি সংবিধানের মূল্যবোধগুলিকে অনায়াসে প্রাপ্ত বলিয়া ধরিয়া লওয়া হইত, কিন্তু বিগত কয়েক বৎসরে যত তাহার মূল নীতিগুলি বারংবার প্রশ্নের সম্মুখীন হইয়াছে, শব্দটিও জনমানসে তত বেশি করিয়া গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়া আসিয়াছে।

Advertisement

এই নঞর্থক দৃষ্টিভঙ্গিটি কঠোর ভাবে সত্য, কিন্তু একমাত্র সত্য নহে। ‘সংবিধান’ শব্দের জনপ্রিয়তার পশ্চাতে একাধিক সদর্থক ভাবনার স্ফুরণও আছে। সংবিধান লইয়া জনতার অনুসন্ধিৎসায় মূলত তিনটি প্রশ্ন তৈরি হইয়াছে। এক, বিশ্বাস এবং সাম্যের সম্পর্ক কী, এবং বিশ্বাসের স্বার্থে সাম্যের উপর রাষ্ট্র কত দূর হস্তক্ষেপ করিতে পারে? দুই, কেন্দ্র এবং রাজ্যের কাহার কী এক্তিয়ার, তাহারা কতখানি পরস্পর নির্ভরশীল এবং দুইয়ের সম্পর্ক ঠিক কতখানি বৈরী হইতে পারে? এবং অবশ্যই তিন, ভারতের নাগরিকত্ব পাইবার পথে ধর্ম কি কোনও নির্ণায়ক হইতে পারে? এই সকল জবাব খুঁজিতে খুঁজিতেই সংবিধানের সংজ্ঞা নির্ণয় করিবার প্রচেষ্টায় রত হইয়াছেন ভারতবাসী। ১৯৫০ সালে গণপরিষদে যে সংবিধান গৃহীত হইয়াছিল, তাহার ভিত্তি ছিল বিস্তৃত ‘সংবাদ’, যাহার আক্ষরিক অর্থ সংলাপ। সেই সংবাদ আজও চলিতেছে, কিঞ্চিৎ ভিন্ন রূপে, তবে তাহার গুরুত্ব একটুও হ্রাস পায় নাই।

সংবিধান যে মূল্যবোধের শিক্ষাদান করে, কেবল তাহার অনুসন্ধান করিবার জন্যই যদি নূতন প্রজন্ম তাহাকে বইয়ের তাক হইতে রাজপথে লইয়া আসিতে পারে, তাহা হইলে বুঝিতে হয় যে তাহার ভিতর ভারতকে নূতন রূপে রচনা করিবার অসামান্য প্রচেষ্টাও আছে। যে রাজনীতি দ্বারা জনতা চালিত হইতে চাহে, যে রূপ সমাজ ও ব্যক্তির ছত্রচ্ছায়াতেই তাহারা স্বস্তিলাভ করে, সেই গতিতেই আগাইয়া চলে সমাজ এবং রাষ্ট্র। আইন-অমান্য আন্দোলন করিতেও যখন সংবিধানই হাতিয়ার হইয়া উঠে, তখন বুঝিয়া লইতে হয় যে শব্দটি যথার্থই বিদ্যাচর্চার পরিসর হইতে বৃহত্তর সমাজে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বর্তমান সময় সঙ্কটের সময়, তবু সেই সঙ্কটকালেরও একটি রুপালি রেখা পাওয়া গেল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement