ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে জেএনইউ-র পড়ুয়াদের বিক্ষোভ। ছবি: এএফপি
ছাত্র আন্দোলন দমনের যে পন্থাটি দিল্লির রাজপথ প্রত্যক্ষ করিতেছে, তাহা কোনও অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নহে। এমনকি, ছাত্রদের দাবি যদি সম্পূর্ণ অন্যায্যও হয়, তবু নহে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হস্টেল-খরচ বৃদ্ধির প্রতিবাদ করিতেছেন। তাঁহাদের দাবি, খরচ যে পরিমাণে বাড়িয়াছে, তাহাতে আর্থিক ভাবে অনগ্রসর পরিবার হইতে আগত বহু ছাত্রেরই আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িবার উপায় থাকিবে না। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, এক লাফে এতখানি খরচ না বাড়িয়া যদি ধাপে ধাপে বাড়িত, তবুও কি ছাত্ররা একই ভঙ্গিতে আন্দোলনে নামিতেন না? হয়তো নামিতেন। কিন্তু সেই আন্দোলনের ন্যায্যতা বিচার এক প্রশ্ন, ছাত্রদের রক্তাক্ত করিয়া আন্দোলন থামাইবার চেষ্টা আর এক। কর্তৃপক্ষ ভুলিয়াছেন, ইহা রণক্ষেত্র নহে। ছাত্ররা শত্রু নহেন। তাঁহাদের দাবি অন্যায্য হইলে সেই কথাটিও আলোচনার মাধ্যমেই বুঝাইয়া দিতে হইবে। তাহাই গণতন্ত্রের পথ। তাহাই সভ্য সমাজের রীতি। যে কোনও আন্দোলনের ক্ষেত্রেই আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার পথ খোঁজা বিধেয়। ছাত্রদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাহা আরও বেশি জরুরি— কারণ, বৃহত্তর সমাজ, বিশেষত প্রশাসন, এক অর্থে এই ছাত্রদের অভিভাবকও বটে। পুলিশের লাঠিতে অভিভাবকের কর্তব্য সম্পন্ন হয় না।
অতঃপর প্রশ্ন, সুলভ উচ্চশিক্ষার দাবিটি কি অন্যায়? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর হয় না। প্রাথমিক শিক্ষা যে অর্থে মৌলিক অধিকার, উচ্চশিক্ষা সেই অর্থে নহে। বিশেষত ভারতের মতো দেশে সকলকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতেই হইবে, এমন দাবি বাস্তবোচিত নহে। উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশ করিবার প্রথম শর্ত মেধা। এবং সেই অঙ্গনে যে ব্যবস্থাটি কাজ করে, তাহা একটি বাজার ব্যবস্থা— যেখানে সেরা ছাত্র সেরা প্রতিষ্ঠানটিকে খুঁজিয়া লইবেন, এবং মেধার মান যত কমিবে সেই ছাত্র ততই কম দরের প্রতিষ্ঠানে পড়িবার সুযোগ পাইবেন। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বাগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি। ফলে, বাজারের নিয়ম মানিয়াই যদি সেই প্রতিষ্ঠান পঠনপাঠনের খরচ বাড়াইতে চাহে তবে সেই সিদ্ধান্ত একান্ত ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। ছাত্ররা সেই সিদ্ধান্তে আপত্তি করিতে পারেন। বিশেষত, খরচ বাড়ানোর কাজটি ধাপে ধাপে করা সম্ভব কি না, কর্তৃপক্ষের অবশ্যই ভাবিয়া দেখা উচিত ছিল। এখনও আছে। একই সঙ্গে এই কথাটিও ভাবা প্রয়োজন যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খরচটি নিয়মিত বাড়াইয়া গেলে হঠাৎ এই ‘অস্বাভাবিক’ বৃদ্ধির প্রয়োজন হইত না।
তবে কি উচ্চশিক্ষা শুধুমাত্র তাহাদের জন্য যাহাদের যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি আছে? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের দায়িত্ব রাজনীতির, প্রশাসনেরও। মেধাবী অথচ দরিদ্র ছাত্ররা সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়িবার সুযোগ পাইলে দেশেরও বিলক্ষণ লাভ। অতএব, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট তাঁহাদের জন্য বিশেষ জলপানির ব্যবস্থা করিবার আবেদন করা যায়। সরকারও ভাবিয়া দেখিতে পারে, আর্থিক ভাবে অনগ্রসর মেধাবী ছাত্রদের জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা যায় কি না। ছাত্র-রাজনীতি সেই দাবি করিতে পারে। কিন্তু, উচ্চশিক্ষায় বিপুল ভর্তুকি দিয়া সকলকেই কার্যত বিনা খরচে পড়িবার সুযোগ করিয়া দিতে হইবে, এই দাবি পরিত্যাজ্য। বস্তুত, এ-হেন অসঙ্গত দাবি ছাত্রছাত্রীদের যথার্থ দাবিরও ক্ষতি করে। এই মুহূর্তে যেমন প্রয়োজনভিত্তিক জলপানির পরিমাণ এবং সংখ্যাবৃদ্ধির প্রসঙ্গটি হারাইয়া যাইতেছে। ভারতে উচ্চশিক্ষার প্রসার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সাধারণ ঘরের যোগ্য ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়াও অত্যাবশ্যক। কিন্তু তাহার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু এবং সুচিন্তিত নীতি। বুদ্ধিহীন খয়রাতি-তন্ত্র এবং বিবেচনাবর্জিত দমন-তন্ত্র, কোনওটিই সুচিন্তার পরিচয় দেয় না।