Amiya Kumar Bagchi

ইতিহাসের নামে গালগল্প নয়

ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের ৮০তম অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন অমিয়কুমার বাগচী (ছবিতে)। বিভিন্ন অনভিপ্রেত বিতর্কও ইতিহাসচর্চার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করতে পারেনি, বললেন তিনি। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০২
Share:

অমিয়কুমার বাগচী।

ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের ৮০তম অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন অমিয়কুমার বাগচী (ছবিতে)। বিভিন্ন অনভিপ্রেত বিতর্কও ইতিহাসচর্চার মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করতে পারেনি, বললেন তিনি।

Advertisement

প্রশ্ন: কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান কি তাঁর ভাষণে সাম্প্রতিক বিস্ফোরক রাজনীতির উপর অনভিপ্রেত গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন?

অমিয়কুমার বাগচী: অনভিপ্রেত তো বটেই। ১৯৩৫ সালে ইতিহাস কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাবর্ষে উদ্যোগীরা বলেছিলেন যে দেশের সকল পেশাদার ইতিহাসবিদ, ইতিহাসের শিক্ষক এবং গবেষকদের এই কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায় স্থান দেওয়া হবে এবং তাঁরা সাক্ষ্যভিত্তিক ইতিহাসচর্চার উপর গুরুত্ব আরোপ করবেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাবাদর্শের ভিন্নতাকে অগ্রাহ্য করে তাঁরা অতীত ও বর্তমানের ইতিহাসচর্চা করবেন। উপরন্তু, বর্তমান বিশ্লেষণ করার সময়েও, প্রচার এড়িয়ে তাঁরা বাস্তবের নির্মোহ সমালোচনা করবেন। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে ইতিহাসবিদেরা দেশের সমস্যা নিয়েও আলোচনা করবেন।

Advertisement

প্র: রাজ্যপাল কি এই ভূমিকা পালন করেননি?

উ: রাজ্যপাল তাঁর ভাষণে ইতিহাসের বিষয়টিকে পুরো উপেক্ষা করে সিএএ-র প্রচারে লিপ্ত হন। খোলাখুলি একবগ্গা প্রচার। তখন কয়েক জন ছাত্রছাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে প্রতিবাদ করেন। এর পর পুলিশবাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের টেনে হিঁচড়ে সভাকক্ষের বাইরে নিয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীদের এই পরিণতি দেখে বেশ কয়েক জন প্রতিনিধি প্রতিবাদ করেন। তখন পুলিশ চার জন প্রতিনিধিকে গ্রেফতার করে। পরে, উপাচার্যের মধ্যস্থতায় তাঁরা ছাড়া পান।

প্র: এই ঘটনা সামগ্রিক অধিবেশনের উপর কেমন ছায়া ফেলে?

উ: রাজ্যপালের বিদায়ের পর পরিবেশ পুনরায় শান্ত হয় এবং অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী গবেষক-শিক্ষকেরা নির্ধারিত সেশনগুলিতে তাঁদের নিবন্ধ পাঠ করেন। ইরফান হাবিব সিনক্রেটিক কালচার বা বহুমুখী সমন্বয়ী সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেন, যে সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিলেন সন্ত কবীর ও গুরু নানক।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কে এম শ্রীমালী ভারতে চর্চিত এবং অনুসৃত প্রতিবাদী, বস্তুতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও পরম্পরার উপর আলোকপাত করেন, বিশেষ করে চার্বাকের দর্শনের উপর।

সুগত বসুর ভাষণের বিষয় ছিল মহাত্মা গাঁধীর চিন্তা ও কর্মোদ্যোগ। তিনি হাফিজ়ের সেই ঐতিহাসিক মন্তব্য উদ্ধৃত করেন যেখানে বলা হয়েছে, ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেন না, পক্ষান্তরে মানুষই ঈশ্বর সৃষ্টি করে।

প্র: নিবন্ধপাঠের এই বিষয়বৈচিত্র থেকে চিন্তা ও অঙ্গীকারের কয়েকটি মূল সূত্র বার হয়ে আসে...

উ: প্রথম যে সূত্রটি উঠে আসে তা হল সাক্ষ্যভিত্তিক ইতিহাস চর্চা। ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেস তার জন্মক্ষণ থেকেই এই সাক্ষ্যভিত্তিক ইতিহাস পাঠ ও প্রণয়নের উপর জোর দিয়ে এসেছে। অর্থাৎ কল্পকথা, রূপকথা, পুরাণকে আশ্রয় করে প্রকৃত ইতিহাস নির্মাণ করা যায় না। ইতিহাসের ভিত্তি হল সুদৃঢ় বাস্তব। পুরাণ-নির্ভর ভ্রান্ত ইতিহাস সৃষ্টির দৃষ্টান্ত আমরা প্রায় প্রত্যেক দিনই পাচ্ছি, তার মাত্র একটি ভয়াবহ উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। দৃষ্টান্তটি হল গণেশ ঠাকুরের হস্তিশির বহন। এক জন প্রবল পরাক্রান্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দাবি করেছিলেন যে গণেশের অবয়বের উপর হস্তিশির স্থাপনই প্রমাণ করে যে ভারতে অতীতে প্লাস্টিক সার্জারির চল ছিল!

দ্বিতীয় যে সম্পর্কিত সূত্রটি উঠে আসে, তা হল বিজ্ঞান ও ইতিহাসের প্রার্থিত নৈকট্য। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল নয়, বিজ্ঞানের সত্যতা যে মানতে অপারগ, তার কোনও ইতিহাসবোধই নেই, এবং সে যেন অবৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ভ্রান্ত ইতিহাসচর্চা না করে। এই ধরনের পুরোপুরি ভ্রমাত্মক, অনৈতিহাসিক কল্পনার ফল মারাত্মক হতে পারে— যেমন, সেই হাস্যকর বিশ্বাস যে আর্যরা কোনও এক সময়ে আমাদের ভারতে বা তথাকথিত আর্যভূমিতে জন্ম নিয়েছিলেন, তাঁরা মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে আসেননি। এই ভাবে ডারউইন ও ‘অভিবাসন তত্ত্ব’-কে নস্যাৎ করা কোনও যথার্থ, যোগ্য ইতিহাসবিদের কাজ নয়।

প্র: শোনা গেল, আপনারা এক দিকে বিশ্বচেতনা এবং অন্য দিকে দেশের বর্তমান পুরাণ প্রাবল্যকে স্মরণে রেখে বেশ কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করছেন...

উ: এই প্রস্তাবগুলির ভিতর উল্লেখ্য হল: ১) ইতিহাসের সর্বজনীনতা অক্ষয়, অটুট রাখতে হবে। ২) পুলিশ যে ভাবে জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস চালিয়েছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ৩) আজকের শাসকেরা রেনোভেশন বা সংস্কারের নামে প্রাচীন স্থাপত্য এবং পুরাকীর্তির যে ক্ষতিসাধন করছেন, তাও অতি অবশ্য বন্ধ করতে হবে। ৪) পাঠ্যপুস্তকে প্রকৃত ইতিহাসের পরিবর্তে বা ইতিহাসের নামে রূপকথা, অবৈজ্ঞানিক গল্প চালানো চলবে না। ৫) আমাদের সব ক’টি দাবি ও প্রস্তাবের অন্তঃসার হল ইতিহাসকে পূর্ণশতাংশ সাক্ষ্যভিত্তিক হতে হবে।

মূল কথা হল, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকতেই পারে, মতামতের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র থাকতেই পারে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা ইতিহাসের নামে গালগল্প সরবরাহ করব।

সাক্ষাৎকার: শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement