শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরির বই মোড় ফিরিয়ে দিয়েছিল
Satyajit Ray

শিক্ষানবিশের পাঠক্রম

কলেজের পাট চুকিয়ে মায়ের কথা রাখতে তাঁকে যেতে হল শান্তিনিকেতনে। চারুশিল্প হিসেবে চিত্রকলা বিশেষ টানত না তাঁকে।

Advertisement

সোমেশ্বর ভৌমিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২০ ০০:৪৭
Share:

আজ ভাবলে মজাই লাগে, সত্যজিৎ রায় প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়েছিলেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। পড়তে চেয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষয় নির্বাচন করতে হয়েছিল পিতৃবন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের পরামর্শে। নিজে বার বার বলেছেন, অর্থনীতির ডিগ্রিটা তাঁর কোনও কাজেই আসেনি।

Advertisement

কলেজের পাট চুকিয়ে মায়ের কথা রাখতে তাঁকে যেতে হল শান্তিনিকেতনে। চারুশিল্প হিসেবে চিত্রকলা বিশেষ টানত না তাঁকে। কলেজে থাকতে বিজ্ঞাপনের খুঁটিনাটি নিয়ে কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, ফলে চেয়েছিলেন কমার্শিয়াল আর্ট শিখতে। শান্তিনিকেতনে এ সব শেখার সুযোগ ছিল না। তবু সত্যজিৎ শেখা শুরু করলেন নন্দলাল বসুর কাছে, আয়ত্ত করলেন ছবি আঁকার প্রাথমিক কলাকৌশল। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিখলেন ক্যালিগ্রাফি। শান্তিনিকেতনের শিক্ষা সম্পূর্ণ করেননি তিনি। কলকাতায় জাপানি বোমা পড়বে, এই ভয়ের আবহে ফিরে আসেন ভবানীপুরের বাড়িতে। কিন্তু এই শান্তিনিকেতনেই সত্যজিৎ পেলেন এক অমূল্য রত্নভান্ডারের সন্ধান। স্কুলজীবন থেকে সুপরিচালিত, সু-অভিনীত ও সু-বিজ্ঞাপিত হলিউডি সিনেমা দেখে বেড়ে-ওঠা, তারকা প্রথা আর স্টুডিয়ো-ব্যবস্থার গুণগ্রাহী তরুণ সত্যজিতের সামনে খুলে গেল সিনেমা আস্বাদনের এক বিকল্প পথ।

কী সেই রত্নভান্ডার? শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগার। এখানে সত্যজিৎ খুঁজে পেয়েছিলেন চলচ্চিত্র বিষয়ে কয়েকটি বই: মার্কিন চলচ্চিত্র-বিশেষজ্ঞ লিউইস জেকব্‌স-এর দ্য রাইজ় অব দি আমেরিকান ফিল্ম (১৯৩৯); সোভিয়েট পরিচালক স্বেভোলোদ পুদভকিন-এর তাত্ত্বিক লেখার ইংরেজি অনুবাদ পুদভকিন অন ফিল্ম টেকনিক (১৯৩০) আর ফিল্ম অ্যাক্টিং (১৯৩৯), অনুবাদক আইভর মন্টেগু; ব্রিটিশ চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ পল রোথা-র দ্য ফিল্ম টিল নাউ (১৯৩০) আর ডকুমেন্টারি ফিল্ম (১৯৩৯); অন্য এক জন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ রেমন্ড স্পটিসউড-এর আ গ্রামার অব দ্য ফিল্ম: অ্যান অ্যানালিসিস অব ফিল্ম টেকনিক (১৯৩৫), জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ ও চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক রুডল্‌্‌ফ আর্নহেইম-এর ফিল্ম (অথবা ফিল্ম অ্যাজ় আর্ট)-এর ইংরেজি অনুবাদ (১৯৩৩), অনুবাদক এল এম সিয়েভকিং ও ইয়ান এফ ডি মরো। বইগুলোর লেখক এবং প্রতিপাদ্য বিষয়ের ব্যাপারে একটু খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।

Advertisement

আরও পড়ুন: এই অতিমারির মাঝেও সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে বস্টনের নবদম্পতি

লিউইস জেকব্‌স (১৯০৪-৯৭) হলিউডের চিত্রনাট্য লিখতেন। তবে তাঁর মূল কাজ ছিল সমসাময়িক নিরীক্ষামূলক ছবি ও তথ্যচিত্র নিয়ে গবেষণা। ব্যবসায়ী মহল, দর্শক ও কলাকুশলীদের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে মার্কিন চলচ্চিত্রশিল্পের বিবর্তনের ইতিহাস লেখেন তিনি। অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার স্বেভোলোদ পুদভকিন (১৮৯৩-১৯৫৩) ছিলেন চলচ্চিত্রবেত্তা লেভ কুলেশভ-এর (১৮৯৯-১৯৭০) সহযোগী। ছবি করার পাশাপাশি পড়িয়েছেন মস্কোর গেরাসিমভ ইন্সটিটিউট অব সিনেম্যাটোগ্রাফি-তে। চলচ্চিত্র-সম্পাদনা নিয়ে ছিল তাঁর নিজস্ব তত্ত্ব। মূলত সোভিয়েট সিনেমার তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ করে চলচ্চিত্রের প্রকৌশল ও অভিনয় নিয়ে লেখেন দু’টি বই, শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগারে যেগুলো এসে পৌঁছেছিল।

পল রোথা-র (১৯০৭-৮৪) আসল নাম পল টমসন। তথ্যচিত্র-নির্মাতা, চলচ্চিত্র-সমালোচক ও লেখক রোথা প্রথম বইয়ে চেষ্টা করেছেন পৃথিবীর যেখানে যেখানে চলচ্চিত্র-উৎপাদন হয়, সেই সব উৎপাদনক্ষেত্রের ব্যাপারে বিশদ ধারণা দিতে। দ্বিতীয় বইটির নাম থেকেই বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। তবে মনে রাখা দরকার, জন গ্রিয়ারসনের (১৯৯৮-১৯৭২) সহযোগী হয়েও রোথা তথ্যচিত্রের উদ্দেশ্য বিষয়ে তাঁর থেকে ভিন্ন মত পোষণ করতেন। তাঁর মতে, তথ্যচিত্র হবে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার। লক্ষণীয়, বই দু’টিকে পরিপূরক বলেছেন রোথা নিজেই।

রেমন্ড স্পটিসউড (১৯১৩-৭০) চলচ্চিত্র বিষয়ের লেখক ও তাত্ত্বিক। অক্সফোর্ডে পড়তে পড়তেই বইটি লেখেন, যেখানে সের্গেই আইজ়েনস্টাইন (১৮৯৮-১৯৪৮), স্বেভোলোদ পুদভকিন আর গ্রিয়ারসন-এর লেখাপত্র বিশ্লেষণ করে চলচ্চিত্রকে এক নতুন তিলোত্তমাশিল্প হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা ছিল। রুডল্‌ফ আর্নহেইম (১৯০৪-২০০৭) আদতে মনস্তত্ত্ববিদ, ‘গেস্টল্ট’ মতবাদের প্রভাবে মানুষের মন ও আচরণের সমগ্রতায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর কাজের মূল ক্ষেত্র ছিল মনের উপরে দৃশ্য ও দৃশ্যকলার প্রভাব। ছোট্ট এই বইয়ে আর্নহেইম প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, সিনেমা হল দৃশ্যকলার এক নবদিগন্তের উন্মোচন। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি বই সাড়া ফেলে, পরে ‘ক্লাসিক’ আখ্যা পায়। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে এ সব বইয়ের পুনর্মুদ্রণ ও নতুন সংস্করণ হয়েছে, আশির দশকেও চলচ্চিত্রের ছাত্রেরা এগুলো পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকত।

সত্যজিৎ যখন শান্তিনিকেতনে যান, তখনও রবীন্দ্রনাথ জীবিত। এর অর্থ, বইগুলো তাঁর জ্ঞানত, এবং অনুমোদনেই, শান্তিনিকেতনে এসেছিল। আমরা জানি না তারা সেখানকার লাইব্রেরিতে কী ভাবে পৌঁছয়। ১৯৩০ সেপ্টেম্বরে দু’সপ্তাহের মস্কো ভ্রমণে দু’দিন কয়েক ঘণ্টা সোভিয়েট ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় চলচ্চিত্র-সঙ্ঘ ‘সোয়ুজকিনো’য় কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তার পর সেখান থেকে মাঝে মাঝেই তাঁর কাছে পত্রিকা আসত। পুদভকিনের বইগুলো তাঁরাই পাঠিয়েছিলেন কি? কে নির্বাচন করেছিলেন জেকব্‌স, রোথা, স্পটিসউড আর আর্নহেইম-এর বই? জানি না আমরা। তবে এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই, বইগুলোর নির্বাচনের পিছনে ছিল সিনেমা বিষয়ে সে-যুগের পক্ষে ব্যতিক্রমী ধারণা ও সুনির্দিষ্ট ভাবনা। আমাদের জানার উপায় নেই, রবীন্দ্রনাথ নিজে বইগুলো পড়েছিলেন কি না। অবশ্য এ কথা জানা, সিনেমা নিয়ে তাঁর উৎসাহের সূচনা ১৯২০-র দশকেই। তখন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মধু বসুর মতো পরিচালকেরা তাঁর সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছেন, মাধ্যমটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করছেন। কবি নিজেও সিনেমার খুঁটিনাটি বোঝার চেষ্টা করছেন। তবে এ ব্যাপারে তাঁর সমস্ত তথ্যের মূল উৎস তখনকার বাংলা সিনেমা। ১৯২৯ নভেম্বরে শিশিরকুমারের ছোট ভাই মুরারি ভাদুড়ীকে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন সিনেমা বিষয়ে তাঁর উপলব্ধির কথা। সিনেমাকে সাহিত্য-নিরপেক্ষ স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্পমাধ্যম হিসেবে দেখতে চেয়েছেন তিনি, বলেছেন সিনেমা হয়ে উঠুক ‘দৃশ্যের গতিপ্রবাহ’ আর ‘রূপের চলৎপ্রবাহ’। প্রায় একই ভাবনার প্রতিফলন আছে পুদভকিন আর আর্নহেইম-এর বইয়ে।

তাঁর জন্মের (২ মে, ১৯২১) নিরানব্বই বছর পূর্ণ হওয়ার এই সময়টিতে আমরা তাই মনে করতে পারি যে, সত্যজিৎ পরিচালক জীবনের নানা পর্বে নানা কথোপকথনে বইগুলোর উল্লেখ করেছেন, বলেছেন এ সব পড়ে সিনেমার শিল্পরূপ বিষয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সির ডিগ্রি তাঁর কোনও কাজে আসেনি। শান্তিনিকেতন নিয়েও খুব উচ্ছ্বসিত হননি কখনও। এমনও নয় যে ১৯৪২ ডিসেম্বরে শান্তিনিকেতনের পাট চুকিয়ে কলকাতা ফিরেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ নিয়ে নিয়মিত অনুশীলনে। তা তিনি শুরু করবেন ১৯৪৭-এ, বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে ‘দ্য ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’ পত্তন করে। কিন্তু কলকাতা থেকে ১০৪ মাইল দূরের এক ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক’টি বই তাঁকে কয়েক পা হলেও এগিয়ে দিয়েছিল এক শিল্পের পথে, যা পরে ইতিহাস সৃষ্টি করবে। রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ ভূমিকাও ভোলা চলে কি?

আরও পড়ুন: পার্থসারথি নহেন

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement