ছবি: সংগৃহীত
ভাগলপুরের বাঙালিটোলার সরকারি নাম মানিক সরকার চক। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে দেখি এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড। রাস্তার ওপর মৃতদেহ শোয়ানো! পরিজনদের প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিবেশীদের তৎপরতা দেখে বোঝা গেল, মৃত্যু অপঘাতে। দ্রুত এলাকা ছেড়ে বেরোলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন বাঙালিটোলার এক পুরনো অধিবাসী, অধুনা কলকাতাবাসী। ঠাট্টা করে জানতে চাইলেন, ‘কেমন দেখলে বাঙালিটোলার শবদেহ?’
আশি-নব্বইয়ের দশকে লেখাপড়ার সূত্রে প্রায় বছর দশেক ভাগলপুরে ছিলেন তিনি। যে দোকানে মিষ্টি খেতেন, সেটা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। দোকানসুদ্ধ আস্ত গলিটাই আর খুঁজে পাওয়া গেল না! তার জায়গায় উঠেছে মাল্টিপ্লেক্স।
শরীরের কলকব্জার দৈন্যদশা দেখেই অনুমান হল, হৃদয়ের না জানি কী হাল! ঠিক তা-ই। প্রবাসী পাড়ার প্রাণভোমরা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ গিয়ে দেখলাম, অবস্থা তথৈবচ। সকালে বন্ধ ছিল। সামনের পানের দোকানে জানা গেল, সন্ধে সাতটায় খোলে, মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের জন্য। নির্দিষ্ট সময় গ্রন্থাগারিক স্নেহেশ বাগচী এলেন, আলো-পাখা চালু করলেন। দু’এক জন পাঠককেও দেখলাম। তবে বেশির ভাগ বইই আলমারি বোঝাই হয়ে অবহেলায় পড়ে। জানলাম, ওঁরা সরকারি সাহায্য নেবেন না, কেননা সে ক্ষেত্রে হিন্দি বই নেওয়া বাধ্যতামূলক। এবং বুঝলাম, এই দশাই বিন্দুতে বাঙালিটোলার হতশ্রী সিন্ধুকে চিনিয়ে দেয়। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মনে পড়তে পারে— ‘তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?/ কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?’ তবে, লঙ্কাপুরীর একটা সোনার সময়ও ছিল।
১৯০৫। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘...এই সাহিত্যই নাড়ীজালের মতো বাংলার পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণকে এক বন্ধনে বাঁধিয়াছে;... ইহা নিশ্চয় জানিতে হইবে যে, বাংলা সাহিত্য যত উন্নত সতেজ, যতই সম্পূর্ণ হইবে, ততই এই সাহিত্যই বাঙালি জাতিকে এক করিয়া ধারণ করিবার অনশ্বর আধার হইবে।’ (আত্মশক্তি) বাংলার সেই কাঙ্ক্ষিত ঐক্যসাধন কে করতে পারে? রবীন্দ্রনাথ ডাক দিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎকে। জেলায় জেলায় শাখা সভা স্থাপন করার আহ্বান জানালেন। ১৩১১ বঙ্গাব্দে প্রসারিত হল পরিষৎ— প্রথম শাখা রংপুরে (এখন বাংলাদেশ) এবং দ্বিতীয় শাখা ভাগলপুরে। কিন্তু কেন ভাগলপুর? ভাগলপুর তখন উদীয়মান বাঙালি সাহিত্যিকদের পীঠস্থান। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গিরীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ ভট্ট, যোগেশচন্দ্র মজুমদার, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, নিরুপমা দেবী প্রমুখ ‘সাহিত্য সভা’ নামে এক আলোচনা চক্র গড়ে তুলেছিলেন। পরিষৎ-এর শাখা স্থাপনে ভূমিকা নিলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, অতুল সেন, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার ও মণীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
১৯১০ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি সেখানে যান রবীন্দ্রনাথ, উপলক্ষ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের তৃতীয় অধিবেশন। প্রসঙ্গত, ভাগলপুরেও তাঁর একটি বাড়ি ছিল: টিলাকুঠি। এখন সেই বাড়ি ‘রবীন্দ্র ভবন’, ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ক্লাস হয়। সম্মিলনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ভাগলপুরের এই সম্মিলনটি সার্থকতা ও উৎসাহে অপর সম্মিলন দুটিকে বহু পশ্চাতে ফেলেছে।’ আগের দু’টি সম্মিলন হয়েছিল বহরমপুর ও রাজশাহিতে। উল্লেখযোগ্য, এই সূত্রে ভাগলপুরে একটি সংগ্রহশালাও তৈরি হয়।
পরিষৎ ও বাঙালিপাড়ার যে অবক্ষয়, তা আজ স্পষ্ট দেখা গেলেও, প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ দিন ধরে সেই প্রক্রিয়া চলেছে। গোড়া থেকেই অভিযোগ, পরিষৎ-এর নামযশ বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লেও ভেতরে সেই ছাপ তেমন ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ১৯৩২ পর্যন্ত কখনও ভাগলপুর ইনস্টিটিউটের একটি ঘরে, কখনও ভাড়া বাড়িতে পরিষৎ-এর কাজকর্ম চলত। শেষ অবধি স্থানীয় রাজবাড়ির দক্ষিণে ১২৭৫ টাকায় পাওয়া যায় ৩ কাঠা ৮ ধূর জমি। এখনও সেটাই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ মন্দির। তিন মাথার মোড়ে এই জমির স্থান-মাহাত্ম্যও সাংঘাতিক। ১৮১০ সালে আদমপুর ঘাটে নৌকা থেকে নেমে পাল্কি চড়ে এর উত্তরের রাস্তাটি দিয়ে শহরে ঢুকেছিলেন রামমোহন রায়। ১৮৯০ সালে উত্তর ভারত যাত্রার সময় সাত দিন ভাগলপুরে ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, এবং দক্ষিণের রাস্তাটিতে হাঁটতে বেরোতেন তিনি। এখন এই রাস্তার নাম ‘বিবেকানন্দ পথ’। আর তিন নম্বর রাস্তায় রাজবাড়ির কুমার সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নাট্যপ্রেমী বন্ধুদলের সঙ্গে খেলতেন শরৎচন্দ্র।
পরিষৎ-এর ৭৫ বছর উদ্যাপনের সময় তৎকালীন সম্পাদক অমলেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘সোনা থেকে নুনের দাম দশগুণেরও ওপর বাড়ল, কিন্তু চাঁদা বস্তুটি একেবারে জগন্নাথের রথ হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, পরিষৎ কিন্তু তবুও চলছে।’ ১৯৮১। নীতির ক্ষয় স্পষ্ট। গত পনেরো বছরের হিসেব বলছে, প্রত্যেক ন’টা বইয়ের একটা করে খোয়া গিয়েছে, মোট ৮৫০-এর কাছাকাছি। কিন্তু সভ্য সংখ্যা আর বই জোগানের তুলনায় তা কিছুই নয়। অতএব, তখনও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জ্বলজ্বল করেছে পরিষৎ। চাহিদা বলতে কেবল চাঁদা আদায়ে গতি আনা এবং নীতিবোধের উন্নয়ন।
কিন্তু আজকের সমস্যাটি অভূতপূর্ব— অস্তিত্বের সঙ্কট। যে গুটিকয়েক প্রৌঢ় আজ পরিষৎ চালান, তাঁরাই শিবরাত্রির সলতে। এর পর আর কোনও প্রজন্ম বাংলাই জানে না, পরিষৎ করা তো দূরের কথা! বর্তমান সম্পাদক অঞ্জন ভট্টাচার্য জানান, ভাগলপুর শহরে বাঙালির সংখ্যা ভীষণ ভাবে কমে গিয়েছে। সারা বছরে দু’একটি বাংলা গানের অনুষ্ঠান হয়, সঙ্গে নাচ। কখনওসখনও রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি হয়, তবে তা ইংরেজি বা হিন্দি হরফে পড়িয়ে মুখস্থ করানো! তিনি লিখছেন, ‘এক সময়ে বাঙালি যে ভাবে চারিদিকে ছেয়ে গেছিল তার পেছনে প্রধান কারণ ছিল— তাদের অসংখ্য গুণ। গুণগত পতন এসেছে আমাদের।’ তবে অতীতের গৌরব ফেরাতে গেলে একজোট হতে হয়, তা আজ আর সম্ভব নয়, কেননা ভাগলপুরের বাঙালি এখন সামাজিক বিপন্নতায় গ্রস্ত— ‘সোশ্যাল ভালনারেবলিটি’।
সঙ্কটের মূল কারণ তিনটি। এক, বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া উঠে যাওয়া। এক সময় বাঙালিদের লেখাপড়ার জায়গা ছিল দুর্গাচরণ বিদ্যালয়। সে সময় সুন্দরবতী মহিলা কলেজ এবং ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ গমগম করত, বাংলাদেশ থেকেও অনেকে পড়তে আসতেন। আজ সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা তো বটেই, বনেদি জমিদার বাড়ির বাঙালি সন্তানরাও ইংরেজি বা হিন্দি মাধ্যমে লেখাপড়া করে না। দুই, ভাষিক সংখ্যাগুরুদের আধিপত্য ক্রমশ বেড়ে যাওয়া। গত কয়েক দশকে বিহারে জাতপাতের অঙ্ক বদলেছে, বেড়েছে ভূমিহারদের প্রতাপ, দখল হয়েছে বাঙালিদের এলাকা। এক কালে পূর্ণিয়া, জামালপুর, ভাগলপুরে ব্যাঙ্ক এবং রেলে চাকরি করতেন বহু বাঙালি যুবক। তাঁরা একজোট হয়ে পত্রিকা বা থিয়েটারের উদ্যোগ করতেন। কিন্তু যে কোনও জাতির মতোই বাঙালিও কেন্দ্রমুখী, কলকাতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিলই, চাপের ফলে বাস্তবেই তা ঘটল। উচ্চাভিলাষী কেউ কেউ আবার দিল্লিও চলে গেলেন। তিন, দেশের অন্যান্য প্রান্তের প্রবাসীদের সঙ্গে বিবাহসূত্রেও অনেকে ভাগলপুর ছেড়েছেন।
সুতরাং, ভাগলপুরের বাঙালি সমাজের হাল ধরার মতো আজ আর কেউ নেই। এক কালে মহাশয় মহেশ ঘোষ, টুবলুবাবু, পটলবাবুর মতো বনেদিরা প্রবল সম্মানিত ছিলেন এলাকায়। ছিলেন বহু নামকরা বাংলার শিক্ষকও। তাঁরা হয় আজ বঙ্গবাসী, নয়তো পঞ্চভূতে বিলীন। বনফুলের বাড়ি, কিশোরকুমারের মামাবাড়ি, শরৎচন্দ্রের মামাবাড়ি সবই এখন ভূতের মতো অন্ধকারে। অবক্ষয়ের ধাপগুলো অনেকটা এ রকম— সামাজিক চাপ, পরিচিতির সঙ্কট, বাঙালির দাম পড়া, এবং বাংলা ভাষায় অনীহা।
এই অবক্ষয় হয়তো কিছুটা ঠেকানো যেত, যদি ভাগলপুরের বাঙালিদের একটা কেন্দ্র থাকত— পরিষৎ। তাকে ঘিরে প্রবাসী পাড়ার বাঙালিয়ানা গড়ে না উঠলেও টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করাই যেত। কেননা ব্যক্তি যা পারে না, প্রতিষ্ঠান পারে। প্রতিষ্ঠানের সে যোগ্যতাও ছিল। গ্রন্থতালিকা বাঙালির সহৃদয় পাঠকসমাজের লোভ না লাগার মতো নয়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বঙ্গের বাহিরে বাঙালী’, রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বঙ্গীয় কুলশাস্ত্র’, নগেন্দ্রনাথ বসুর ‘বাঙালির জাতীয় ইতিহাস’ ইত্যাদি। কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও বাঙালির পাশে বাঙালি দাঁড়াবে না? সম্পাদক রতন নন্দীর থেকে জানা গেল, ‘কলকাতার মতো বাংলা সাহিত্যের উপাদান ভাগলপুরে নেই, এই বাস্তব মানতেই হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় বাধা দূরত্ব। অর্থনৈতিক বিপত্তিও যে নেই, তা নয়।’
আসলে, পরিষৎ কেবল সমাজের এক স্তরের মানুষের হাতে থেকে যাওয়াতেই তা আর সর্বজনের মধ্যে ছড়াতে পারল না। অতএব, শেষমেশ বংশে বাতি দিতেও আর কেউ রইল না। এখন কেবল সাদা-কালো অতীতচারণা আর ভবিষ্যতের দিন গোনা।