প্রতীকী ছবি।
মুজফ্ফরপুরে বর্ষা নেমেছে। এ বারের মতো শিশুদের মৃত্যুমিছিল থামল। দেড়শোরও বেশি শিশুকে পর পর মারা যেতে দেখে আমরা বিচলিত হলাম। কিন্তু কিছু শিখলাম কি? না কি আবার অসহায় ভাবে উপলব্ধি করলাম একই দেশে দুই দেশের অস্তিত্ব? একটা দেশ যখন তার মস্ত শহরের হাসপাতালে রোবোটিক্স সার্জারি করে, কয়েকশো কিলোমিটার দূরে গ্রিন করিডর তৈরি করে হৃৎপিণ্ড পাঠায় প্রতিস্থাপনের জন্য, তখন অন্য দেশটিতে খালি পেটে শুতে যায় শিশুরা। সকালে গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে ফল খায়। তার জেরে জ্বর, খিঁচুনি শুরু হলে তাদের নিয়ে যেতে হয় প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে মেডিক্যাল কলেজে, যেখানে চল্লিশ জনের ওয়ার্ডে স্থান হয় পাঁচশো শিশুর। এর নাম জনস্বাস্থ্য? এই কি চিকিৎসার নমুনা?
লিচু খাওয়ার পরে অপুষ্ট শিশুদের মস্তিষ্কের প্রদাহ (অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিন্ড্রোম) থেকে মৃত্যু হতে পারে, এ কথা অজানা নয়। ১৯৯৩ সাল থেকেই এই অঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ‘চমকি বুখার’। হঠাৎ ধুম জ্বর, জ্ঞান হারানো, খিঁচুনি, এই ছিল অসুখের প্রধান লক্ষণ। ২০১২-১৩ সালে বেশ কিছু মৃত্যু হয়েছিল এই রোগে। ২০১৪ সালে যখন একশো শিশুর মৃত্যু হয় তখন সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসে। তবে তার পরে এই রোগে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা কখনও বছরে এগারো ছাড়ায়নি। এ বছর কী ঘটল যে এই রোগের প্রকোপ এত বেড়ে গেল?
একটি মত, এই রোগের সঙ্গে লিচুর যোগাযোগ খুব নির্দিষ্ট ভাবে প্রমাণ করা যায়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞান পত্রিকা ‘ল্যানসেট’ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অবশ্য খালি পেটে লিচু খাওয়াকে দায়ী করে। যে শিশুরা মারা গিয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে সাদৃশ্য রয়েছে। তাদের বয়স এক বছর থেকে আট বছর পর্যন্ত, এবং তারা অপুষ্টির শিকার। তারা অধিকাংশই আগের রাতে অভুক্ত শুতে গিয়েছিল। ভোর বেলায় তারা গাছের তলায় পড়ে-থাকা লিচু খায়। লিচুতে এমন কিছু রাসায়নিক থাকে যা এমনিতে কোনও ক্ষতি করে না, কিন্তু অপুষ্ট শিশুদের রক্তে শর্করা দ্রুত কমিয়ে দেয়। এর পর তাদের শরীরে যে প্রতিক্রিয়া হয়, তার জেরে শিশু অজ্ঞান হয়ে যায়, খিঁচুনি শুরু হয়।
রোগের কারণ নিয়ে যতই বিতর্ক থাক, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যে শক্তিশালী করা দরকার, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। আর জনস্বাস্থ্যের প্রাথমিক পাঠই হল, অপুষ্টি যে কোনও অসুখ, এবং তার থেকে মৃত্যুর প্রধান কারণ। দেশে শিশুপুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্পের কোনও অভাব নেই। কিন্তু তার কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা অত্যন্ত কমজোরি। যে অঞ্চলগুলিতে লিচুর মরসুমে মৃত্যুর ঝুঁকি জানা গিয়েছে, সেখানে লিচু পাকার আগে থেকেই পুষ্টির বিষয়ে নিরন্তর প্রচার, এবং শিশুদের জন্য বাড়তি খাবারের জোগান প্রয়োজন ছিল না কি? অঙ্গনওয়াড়ির মতো প্রকল্পে বরাদ্দ পাঠিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। শিশু শেষ অবধি কী পেল, তা কতটা পুষ্টিকর, তা-ও বুঝতে হবে।
স্বাস্থ্যের বার্তা, পুষ্টির প্রকল্পে তৎপরতায় ভাটা পড়েছে হয়তো এই কারণে যে, এটা ছিল সাধারণ নির্বাচনের বছর। গ্রামে স্বাস্থ্যবার্তার পৌঁছনোর দায়িত্ব যাঁদের, সেই ‘আশা’ কর্মীদের কেন কাজ থেকে সরিয়ে ভোটের কাজে লাগানো হবে? আগের বছরগুলোতে আশা কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের নিয়ে পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে, মসজিদে, নানা সচেতনতার বার্তা প্রচার করা হয়েছে। এ বার হয়নি। শিশুর জীবনের থেকেও কি ভোট বড়?
ভোট আসে-যায়, কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির অবস্থা আর ফেরে না। আজও সেগুলিতে যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর্মী থাকে না, ন্যূনতম পরিকাঠামো থাকে না। এই মৌলিক কাজগুলি করার তাগিদ যাঁদের অনুভব করার কথা, তাঁদের উপরেই বা ভরসা করা যায় কী করে? বিহারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পান্ডে সাংবাদিক সম্মেলনে শিশুমৃত্যু নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে পাকিস্তান-ভারত ক্রিকেট ম্যাচের স্কোর জানতে চেয়ে বসেন। তিনি যখন আক্রান্ত শিশুদের দেখতে মেডিক্যাল কলেজে এসেছিলেন, তখন সঙ্গে এনেছিলেন অ্যাম্বুল্যান্স ও একটা গোটা মেডিক্যাল টিম— না, শিশুদের জন্য নয়, তাঁর নিজের দেখাশোনা করার জন্য! ক্ষমতাবান নিজের প্রাণের বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেবেন না, আর দরিদ্রের কোনও ঝুঁকিই খুব বেশি নয়?
এতগুলি শিশুমৃত্যু সত্ত্বেও বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান করা হচ্ছে বা গবেষণাগার তৈরি হচ্ছে বলে শোনা যায়নি। বরং ২০১৪ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেগুলিই ফের বললেন বর্তমান মন্ত্রী। কোনও মৃতদেহ অটপ্সি হয়নি, শরীরের কোনও অঙ্গের কোষের (হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল) পরীক্ষা হয়নি।
এ বছরের মতো হয়তো ঝুঁকি কমল। তারা আবার খেলবে, হাসবে, স্কুলে যাবে। শুধু মুখে হাসি থাকবে না সেই মায়েদের, যাঁদের সন্তান আর ফিরবে না। আমরাও মন্ত্রীর মতো খোঁজ করব— স্কোর কত?
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ