ত্রিপুরায় বুলডোজারের ধাক্কায় লেনিনমূর্তির পতন হইলে উত্তরপ্রদেশে ভূলুণ্ঠিত ভীমরাও অম্বেডকর। কেরলে গাঁধীমূর্তির চশমা ভাঙিলে, তামিলনাড়ুতে পেরিয়ারের মূর্তি আক্রান্ত হইলে, পশ্চিমবঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তিতে কালি লেপিয়া দেওয়া হয়। দলমতনির্বিশেষে মূর্তি মাত্রেই বিপন্ন। একমাত্র নিরাপদ কি তবে কুষাণরাজ কনিষ্কের মূর্তিখানি? গত কয়েক দিনে যাহা ঘটিতেছে, তাহাকে রাজনীতি বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। মূর্তি ভাঙিবার এই দেশব্যাপী প্রবণতাটি তুলনায় অপরিচিত, কিন্তু তাহার পিছনে থাকা মানসিকতাটি নহে। বস্তুত, ভারতীয় ‘রাজনীতি’র প্রধান চালিকাশক্তি এখন এই মানসিকতাটিই— সহিষ্ণুতার তিলমাত্র না রাখা। ত্রিপুরায় ক্ষমতা দখল করিবার পর বিজেপির সম্ভবত মনে হইয়াছিল, ‘চার ফুট বাই চার ফুট’-এর ভূখণ্ডটি দুর্যোধন-বর্ণিত সূচ্যগ্র ভূমির ঢের বেশি। ভ্লাদিমির লেনিন নামক এক নেতার মূর্তিকে সেই জমিটুকু ছাড়িয়া দেওয়ার অর্থ, বামপন্থীদের রাজনৈতিক জমি ছাড়িয়া দেওয়া। নরেন্দ্র মোদীর ভারত জানে, সেই জমি ছাড়িতে নাই। আরও বেশি জানে, মূর্তি শুধু মূর্তি নহে, তাহা একটি মতের প্রতীক। যেমন, মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী যদি সহিষ্ণুতার মূর্তি হন, ভ্লাদিমির লেনিন শোষণের বিরুদ্ধে দরিদ্রের জয়তিলক, ভীমরাও অম্বেডকর উচ্চ বর্ণের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দলিতের ক্ষমতায়নের নিশান, পেরিয়ার ই ভি রামস্বামী হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দ্রাবিড় প্রতিরোধের প্রতীক। প্রতিটি অবস্থানের সহিত, প্রতিটি প্রতীকের সহিত বিজেপির হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের উচ্চবর্ণ-উচ্চবিত্ত রাজনীতির বিরোধ প্রত্যক্ষ। প্রতিটি মূর্তিই যে বিজেপির কর্মী-সমর্থকরা ভাঙিয়াছে, বিনা তদন্তে তেমন দাবি করিবার কারণ নাই। কিন্তু, মানসিকতাটি কোন বর্ণের, বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন।
নরেন্দ্র মোদী দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাইয়াছেন। গোরক্ষার নামে একের পর এক মুসলমানকে খুন করা হইলেও যিনি নিশ্চুপ থাকেন, নীরব মোদীর মাপের কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হইলেও যাঁহার ‘মন কি বাত’ জানিবার উপায় থাকে না, সেই নরেন্দ্র মোদীর এমন তুরন্ত প্রতিক্রিয়ায় দেশবাসী স্বভাবতই অবাক। শুধু লেনিনমূর্তি ভাঙিলে তিনি এতখানি আঁতকাইয়া উঠিতেন বলিয়া সন্দেহ হয় না। উৎসাহের আতিশয্যে পেরিয়ার এবং অম্বেডকরের মূর্তিতেও হাত পড়ায় তিনি ঘাবড়াইয়াছেন। তাঁহাদের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবশত নহে, ভোটব্যাংকের হিসাব কষিয়া। বৃহত্তর হিন্দুত্বের ছাতায় দলিতদের টানিতে তিনি যেমন উদগ্রীব, তেমনই তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে জায়গা পাইতেও। সেই ক্ষেত্রে অম্বেডকর বা পেরিয়ারের ন্যায় অনতিক্রম্য প্রতীককে আক্রমণ করিয়া বসিলে ভোটের হিসাব ঘাঁটিয়া যাইতে পারে, সম্ভবত সেই আশঙ্কাতেই প্রধানমন্ত্রী তড়িঘড়ি মুখ খুলিয়াছেন। তবে, অসহিষ্ণুতার কান্ডারিরা হঠাৎ সহিষ্ণুতার গীত গাহিলে তাহা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য হয়, কর্তারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন।
মূর্তি ভাঙিয়া বিপ্লবের ভগীরথ হইবার কৃতিত্ব ত্রিপুরার বিজেপি কর্মীদের দেওয়া যাইবে না। অর্ধশতক পূর্বের পশ্চিমবঙ্গ বহু মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদ দেখিয়াছে। প্রাক্তন নকশালরা বুঝিয়াছেন, মূর্তি ভাঙিয়া কাহারও মতবাদ মুছিয়া ফেলা যায় নাই। লেনিন হইতে পেরিয়ার, গাঁধী হইতে অম্বেডকর, প্রতিটি কণ্ঠই ভারতীয় রাজনীতিতে থাকিবে। ভারতীয় রাজনীতির বহুত্ব সহজে মুছিবার নহে। প্রান্তের রাজনীতি বারে বারেই কেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ করিবে, তাহার আধিপত্যকামিতার পালটা আধিপত্য তৈরি করিতে চাহিবে। সাভারকরের প্রতিটি বক্তব্যের বিপ্রতীপে গাঁধীর অবস্থান থাকিবে, উচ্চবর্ণের প্রতিটি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অম্বেডকরের রাজনীতি থাকিবে। ক্ষমতার জোরে মূর্তি ভাঙিয়া ফেলা যায়। কিন্তু, মতবাদ মুছিতে পারে, বুলডোজারের সাধ্য কী?