ছবি: সংগৃহীত
স্বৈরাচারী শাসকেরা অনেকেই আশা করেন, শুধু আজকেই যে তাঁরা ক্ষমতায় আছেন তা নয়, চিরকালই থাকবেন। তাঁরা অনেক সময় এটাও বিশ্বাস করেন যে, ক্ষমতা চলে গেলেও ভবিষ্যতে তাঁদের বর্তমান দুরাচারগুলোর বিচার হওয়ার ভয় নেই। তাঁরা যদি সাধারণ মানুষের কথা বলার সুযোগ বন্ধ করে দেন, বিচার ছাড়াই অনেককে জেলে রাখতে তৎপর হন, সংখ্যালঘুদের জীবনরক্ষায় পুলিশের অকর্মণ্যতা মেনে নেন, এমনকি রাজনৈতিক গুন্ডাদের ‘গোলি মারো’ এই অভিলাষটিতে বাধা না দেন, তা হলেও ভবিষ্যতে এ নিয়ে কেউ বড় সমালোচনার সুযোগ পাবে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা বড় বিভ্রান্তি আজকের স্বৈরাচারীদের সাহস দেয়, সেই সাহসের কোনও বাস্তব ভিত্তি না থাকলেও।
স্বৈরাচারী রাজনীতির জ্ঞানহীনতার সঙ্গে সাধারণ মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তার একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। বিশিষ্ট উর্দু কবি ফৈজ় আহমেদ ফৈজ় তাঁর একটি রচনায় সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, সরকারি দুরাচারগুলো শুধু আজকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এমনটা নয়, ভবিষ্যতেও লোকে সেটা ভুলবেন না। তাঁর ১৯৭৯-তে লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘হম দেখেঙ্গে’ আমাদের সামনে সত্যি-মিথ্যে বিষয়ক জ্ঞানের একটি বড় ভূমিকাকে তুলে ধরে। স্বৈরাচারীরা এখন যতই নিজেদের ভারমুক্ত মনে করুন, যতই ধূর্ততার সঙ্গে অকুণ্ঠিত ভাবে অনাচারগুলো চালিয়ে যান, সাধারণ লোকের এমন একটা সন্দেহ করার খুবই কারণ আছে যে— তাঁদের উপলব্ধিতে বিচারের অভাব আছে এবং সেই অভাবই তাঁদের উস্কানি দেয়। ফৈজ়ের কবিতাটির প্রেক্ষাপট ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া-উল-হকের স্বৈরশাসন, কিন্তু তাঁর এই গভীর চেতনা সর্বত্রই প্রযোজ্য।
তাই, আজ যখন ভারতের মন্ত্রী-পরিষদ ও আইনসভা আমাদের সংবিধানে আদৃত ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের অধিকারকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে, তার ফলে যে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বরঞ্চ আশ্চর্য এটাই যে, দেশে এ-ধরনের একটা নিম্নমুখী পরিবর্তন আনার সময় প্রতিবাদের জোরালো সম্ভাবনাগুলোর ওপর বড়কর্তাদের নজর সামান্যই ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতবাসীদের কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল। বড় প্রচেষ্টায় জেতা ধর্মনিরপেক্ষ এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থাকে চট করে উৎখাত করে দেওয়া যাবে— কোনও রকম প্রতিবাদ ছাড়াই— এ-রকমটা মনে করার কোনও কারণ ছিল না, এখনও নেই।
যদিও দেশের কর্তারা অনেক সময়েই সাধারণ লোকের কথা শুনতে চান না, এবং নানা ভাবে সরকারের সঙ্গে মতবিরোধকে দেশদ্রোহ হিসেবে দেখতে উদ্গ্রীব হন, তবুও এটা আমাদের, সাধারণ মানুষদের সর্বদাই মনে রাখা দরকার যে, প্রতিবাদের সাহায্যেই আমাদের বক্তব্য সবার সামনে তুলে ধরা সম্ভব। সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর যদি সরকারি হস্তক্ষেপে এবং গায়ের জোরে দমন করা হয়, তা হলেও সেই প্রতিবাদ অনেক সময়ই নানা ভাবে দেশি ও বিদেশি কানে পৌঁছে যায়। প্রতিবাদ দমনের সমালোচনা দেশেবিদেশে ধ্বনিত হয়ে সরকারি কু-ব্যবস্থাগুলির দিকে লোকের নজর টানে।
অন্য দেশ থেকে অথবা আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে সমালোচনা এলে দেশি সরকার অনেক সময়ই বলতে চায় যে, বিদেশি কারও এ-দেশি ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে কিছু বলার অধিকার নেই। কিন্তু, পৃথিবীর সকলেরই একে অন্যের দিকে দৃষ্টিপাতের স্বাধীনতা আছে, মানুষের মূল্যবোধ ও সহানুভূতি আন্তর্জাতিক আইনকেও সহজেই ছাড়িয়ে যেতে পারে। কথা বলার স্বাধীনতা জগৎ জুড়ে মানব-অধিকারের সঙ্গে যুক্ত। অন্য দেশের সমালোচনা আমরা প্রায়ই করে থাকি। যেমন পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষের ব্যবহার, আমেরিকার ইরাক আক্রমণ, রুয়ান্ডাতে সংগঠিত জনহত্যা, প্যালেস্টাইনের নাগরিকদের দমন করে রাখা— এ-রকম বহু উদাহরণ সহজেই দেওয়া যায়। যখন অন্যায় ঘটে, তার সমালোচনা বিদেশ থেকে এসেছে, এই অজুহাতে আমরা বক্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করতে পারি না।
আমাদের দেশে বর্তমানে যে প্রতিবাদ চলছে এবং প্রতিবাদ বন্ধ করার জন্য পেশিশক্তির ব্যবহার হচ্ছে, সেই বিষয়ে সাধারণ মানুষের কথা বলার প্রয়োজন খুবই। যাঁদের ওপর দুর্ব্যবহারের চাপ সবচেয়ে বেশি পড়েছে, যেমন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাঁদেরও শক্ত ভাবে দাঁড়াবার প্রয়োজন অত্যন্ত স্পষ্ট। ইদানীং মুসলমান সমাজের মেয়েরা তাঁদের অধিকার বজায় রাখতে যে সাহসী প্রচেষ্টা করছেন তার মধ্যে মূল্যবোধ ও বিচারক্ষমতার পরিচয় নানা ভাবেই দেখা যাচ্ছে।
যুবসমাজকে যে এই রাজনৈতিক প্রতিবাদগুলোতে সামনের সারিতে দেখা যাচ্ছে, এটা একেবারেই অ-সাধারণ কিছু নয়। কিন্তু, এগুলোতে মেয়েদের, বিশেষত মুসলমান সমাজ থেকে এগিয়ে আসা নারীদের নেতৃত্বের ভূমিকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের যোগদানের ফলে আন্দোলনগুলো অনেক বেশি শক্তিমান হচ্ছে।
প্রতিবাদের আঞ্চলিক ছবিটিও ইদানীং অনেকটা বদলেছে। যে-সব অঞ্চলে মেয়েদের নেতৃত্ব খুব স্পষ্ট ভাবে উঠে আসছে, যেমন উত্তর ভারতের বিভিন্ন এলাকায়, দিল্লিতেও, সেই অঞ্চলগুলোতে আগে সাধারণত মেয়েদের কণ্ঠস্বর তুলনায় দুর্বল ছিল। এই পরিবর্তনের গুরুত্ব কম নয়। জঁ দ্রেজ়-এর সঙ্গে আমার যৌথ ভাবে লেখা অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কন্ট্রাডিকশনস (বাংলায় ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা) বইতে ভারতে নারী-পুরুষ বৈষম্যের যে আঞ্চলিক ছবিটা উঠে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে উত্তর ভারতের কিছু রাজ্যে মেয়েদের বঞ্চনা খুবই তীব্র। আজকের প্রতিবাদে সেই পুরনো অসাম্যের কিছু বদলের লক্ষণ দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারে না।
বর্তমান প্রতিবাদগুলির আর একটা দিক হল, যে সংবিধান ও জাতীয় প্রতীকগুলোকে দক্ষিণপন্থীরা দখল করে নিয়েছিলেন, আন্দোলনকারীরা সেগুলোকেই নিজের বলে মনে করে ব্যবহার করতে উৎসাহী। সরকারের সঙ্গে বিরোধ আছে বলেই তাকে দেশদ্রোহ বলা যাবে না, কারণ, দেশ ও সরকার এক জিনিস নয়। জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত সব ভারতীয়েরই অধিকারের মধ্যে পড়ে, এবং সরকার কোনও ভাবেই সেগুলি বাজেয়াপ্ত করতে পারে না।
দেশের এই সঙ্কটময় অবস্থায় যেটা সবচেয়ে জরুরি, তা হল এই অধিকারমূলক চিন্তাধারাকে পাকা করা এবং সংবিধানপ্রসূত অধিকারগুলিকে বড় মানবাধিকারের সঙ্গে যুক্ত করা। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিভেদ করে লোকের রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক অধিকার কমানো চলবে না।
জন স্টুয়ার্ট মিল-এর আলোচনায় আমরা দেখতে পাই যে, গণতন্ত্র বাক্স্বাধীনতার ওপর খুবই নির্ভরশীল। সেই স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং তার সু-ব্যবহার করা গণতন্ত্রের বড় একটা নীতি। সরকারি কর্তাব্যক্তিরা অনেক সময় লোককে নির্বাক করতে ব্যগ্র হলেও, এ বিষয়ে যে জোরালো আলোচনা চলছে তা নিয়ে আমাদের খুশি হওয়ার বড় রকমের কারণ আছে। সম্প্রতি বিচারপতি ধনঞ্জয় যশোবন্ত চন্দ্রচূড় এবং দীপক গুপ্ত গণ-আলোচনার সমর্থনে যে কথাগুলো বলেছেন তাতেও নিশ্চয়ই আমাদের ভরসা পাওয়ার হেতু আছে।
রাজনীতির চর্চায় প্রতিবাদ করার ক্ষমতা এবং সাহসের ভূমিকা খুবই বড়। ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই যে, পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া নানান আচার ও দুরাচারগুলোকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আজ হোক বা কাল, এ সব প্রশ্ন উঠবেই: কেন উত্তর-পূর্ব দিল্লির শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীদের আক্রান্ত হতে হল; কেন পুলিশের সাহায্য তাঁরা পেলেন না, বরং উল্টোটা ঘটল; কেন নীরব মানুষের ঘরবাড়ি পুড়ল; কী ভাবে অনেক ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের
ওপর হামলা চলল; এবং পুলিশ কেন ভুয়ো ভিডিয়োর সাহায্যে দেখানোর চেষ্টা করল যে, যা ঘটেছে তা ঘটেনি?
রাষ্ট্রীয় বাহুবলের সাহায্যে যে তৈরি-করা কাহিনিগুলো অনেক সময় গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলো চিরস্থায়ী নয়। ন্যায় ও ন্যায্যতার প্রয়োজন এবং গণতন্ত্র রক্ষার প্রচেষ্টার সঙ্গে এই প্রশ্নগুলি অঙ্গাঙ্গি জড়িত। এক দিকে যখন— লোকের বক্তব্য দমন করতে— প্রতিবাদ বন্ধ করার নানা রকম প্রচেষ্টা চলতে পারে, তখন প্রয়োজন সুচিন্তা ও সাহসের সঙ্গে সবারই জোরের সঙ্গে দাঁড়ানো। দুর্দিনে, দুর্বিপাকে আমাদের আশার কথা শোনার কারণ নিশ্চয়ই আছে, যে আশা মার্টিন লুথার কিং-এর কণ্ঠে আমরা শুনতে পেয়েছিলাম: ‘আমরা সব বাধা অতিক্রম করব।’ সমাজকে ন্যায্যতার দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের সকলেরই।